প্রকাশ: বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০২৫, ১:২০ পিএম আপডেট: ২৭.০৮.২০২৫ ৪:০১ পিএম (ভিজিটর : ৩৩৭)

সৌন্দর্য আপেক্ষিক। সাহিত্যের সৌন্দর্য তুলনামূলক আরও আপেক্ষিক। শব্দ ও ছন্দের বুননে। মাত্রার পরিমিতবোধে কবিতায় তৈরি হয় নানাবিধ ঝঙ্কার। সেই ঝঙ্কারে কখনও উঠে আসে অনাবিল আনন্দ, কখনও মানবীয় প্রেম, কখনওবা প্রকৃতির সৌন্দর্য অথবা মানব মনের নিগূঢ় অনূভুতি। জাহানারা হক (১৯৬৬) বর্তমান সময়ের একজন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কবি। তাঁর লেখনীতে উঠে এসেছে সমসাময়িক বিভিন্ন অনুসঙ্গ। রয়েছে সমাজ জীবনের নানাবিধ অসঙ্গতি, রাজনৈতিক পালাবদল। এসব বিষয়ের মধ্যে বিশেষভাবে তিনি মানব মনের অনুভূতি তাঁর কাব্যকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন ক্ষয়িষ্ণু মনের আস্তরণ। জাহানারা হক তাঁর কবিতায় মানব মনের সঙ্গে প্রকৃতির এক দারুণ মেলবন্ধন তৈরি করেছেন। নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। তেরোশত নদী বাংলা মায়ের বুক চিরে ধমনীর মতো অসংখ্য জাল বিস্তার করে রেখেছে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলা কবিতায় 'নদী' অনুসঙ্গটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। জাহানারা হকের ' বংশী নদী' কবিতায় কবি প্রিয়কে সঙ্গে নিয়ে বংশী নদীতে বেড়াতে গিয়ে বিশেষ স্মৃতিচারিত হয়েছেন। " প্রাণের স্বামীরে কহিলাম ডেকে/ চলো না একটু ঘুরি/ হরষিত মনে রাজি হয়ে গেলো / চলিল হাতটি ধরে।" কবি তাঁর প্রিয় মানুষের সঙ্গে দীর্ঘ বিরতির পর নৌকায় উঠে চমকিত হয়েছেন। নদীর পানির ছলাৎছলে কবি আবেগে বিহবল হয়েছেন এভাবে " মনের সুখে বৈঠা বাইলাম /পানির ছলাৎছলে / হাসি আনন্দে জীবনানন্দে / বংশী নদীর কোলে।"
'প্রেম' মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সৃষ্টির আদি থেকেই মানবীয় প্রেমের সঞ্চার ছিলো। প্রেমের কারণে মানুষ যেমন এভারেস্ট জয় করতে পারেন, তেমনি পারেন সাঁতরে ইংলিশ চ্যানেলও পাড়ি দিতে। প্রেম শ্বাশত, প্রেম অনাবিল, প্রেমই শক্তি, প্রেমিই দুর্বার। ' ভালোবাসায় নিঃস্ব হব' কবিতায় কবি বলেছেন- " সমস্ত দেহে আমি চিহ্ন রাখবো ভালোবাসার / পরিপূর্ণ একটা লাইন ধরে দীর্ঘ পথ হাঁটতে চাই / চাইলে সাঁতরে পার হব ইংলিশ চ্যানেল / তাই সঞ্চয় করে রেখেছি এভারেস্ট জয়ের শক্তি। "
মানবীয় প্রেম অপার্থিব বলেই প্রিয় তার প্রেয়সীকে এই পৃথিবীর সমস্ত রূপ -রস-গন্ধে অনুধাবন করতে চায়। সব কিছুতেই প্রেয়সীর উপস্থিতি একান্ত কাম্য তার৷ প্রেয়সীর বৃষ্টি ভেজা দৃষ্টি, প্রাণোচ্ছল হাসি কিংবা খাবারের প্লেট বা ব্যবহৃত টিস্যুর সব কিছুতেই প্রিয় তার প্রেয়সীর অস্তিত্ব খুঁজে ফিরেন। কবি তাঁর " ভূমিধস প্রেম" কবিতায় এভাবে বলেছে- " না হলে তোমার গন্ধ-স্পর্শ / এত সৌরভময় কেন/ এটা কোনো শোনা কথার বিশ্বাস নয়।/ আমার সকল ইন্দ্রিয় বলছে তুমি / গন্ধ, আভিজাত্যে, কোমলতায়/ এক শ্রেষ্ঠ নারী।
যদিও ভালেবাসা নিত্য, অমীয় সুধা। তবে দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক অযত্ন, বিচ্ছেদ কিংবা একঘেয়েমি যাই বলা হোক না কেন ধীরে ধীরে ভালোবাসা ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে। যার বাহুডোরে বন্দি ভালোবাসায় মরীচিকা ধরে।
অধরা থেকে যায়। তবু কবি বলেন, ' জেনে নিও ইচ্ছে, স্বপ্ন, নির্ভরতা, ভরসা নিজের মাঝেই পূর্ণতা পায়। ' মা’ বাংলা কবিতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। ' মা' বিশ্বসাহিত্যেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ। যে শব্দটির সাথে গভীর আবেগ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক অনন্য বহিঃপ্রকাশ। জাহানারা হকের 'মা' কবিতায় কবির চোখে মায়ের প্রতি এক অপার মোহনীয়তা প্রকাশমান। " তোমার সেই মায়া ভরা চোখ / সেই চোখ বন্ধ হাসি/ কী মোহনীয় দেখতে তুমি মা। / এক অজানা আবেশে মন ভরে যায়।
জাহানারা হকের কবিতা প্রকৃতির সাথে মানব মনের এক অপূর্ব মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কবি তাঁর স্বীয় মেধায় তীর ভাঙে নিঃশব্দে কাব্যের প্রতিটি কবিতা নশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। পুথিপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটি পাওয়া যাচ্ছে রকমারিতে। মুদ্রিত মূল্য ২৫০ টাকা।
লেখক : প্রভাষক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক