৫ আগস্ট গণঅভ্যুথানের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নানা ইস্যুতে ৩০টির অধিক রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে একাধিবার বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তিনি বারবার জাতীয় ঐক্য গড়ার তাগিদ দিয়েছেন। সর্বশেষ গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানেও তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য গড়ার ওপর গুরুত্ব দেন। কিন্তু গণঅভ্যুথানের পর কয়েক মাস রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য দেখা গেলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে অনৈক্য দৃশ্যমান হয়ে উঠে। সর্বশেষ জুলাই সনদে এসসিপিসহ বেশ কয়েকটি বাম রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর না করায় সেই অনৈক্য আরো বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠে।
এদিকে সনদে স্বাক্ষর করলেও নভেম্বর মাসে গণভোটসহ ৫ দফা দাবি নিয়ে রাজপথে আন্দোলনে রয়েছে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ আটটি রাজনৈতিক দল। তবে জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলো পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে দাবি জানাচ্ছে তার ঘোর বিরোধী বিএনপি। এছাড়া এই দাবির বিরুদ্ধে অবস্থান রয়েছে এনসিপির।
অপরদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর আগে প্রশাসনের বিভিন্ন পদে নিয়োগ ইস্যুতে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতারা একে অন্যকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করে বক্তব্য অব্যাহত রেখেছেন। সব মিলিয়ে নানা ইস্যুতে গণঅভ্যুথানের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য দৃশ্যমান হচ্ছে।
সোমবার রাজধানীর ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশে (আইডিইবি) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার এক বড় সুযোগ এসেছিল, কিন্তু এখন চারদিকে অনৈক্যের সুর। রাজনীতিবিদদের মধ্যে অনৈক্য প্রসঙ্গে হতাশা প্রকাশ করে মির্জা ফখরুল বলেন, অনেকেই এখন হতাশ। এত বড় অভ্যুত্থানের পর দেশকে সুন্দর করার বিশাল সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, রাজনীতিবিদরা ঐক্য হারিয়ে ফেলেছেন।
কেউ চলে যাচ্ছেন, কেউ বিভক্ত হচ্ছেন চারদিকে অনৈক্যের সুর ছড়িয়ে পড়েছে। আর জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেছেন, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনীতিতে আরো সুসংহত ঐক্য প্রতিষ্ঠা দরকার ছিল। কিন্তু দেশের রাজনীতিতে এখন ঐক্যের চেয়ে অনৈক্য বেশি দৃশ্যমান। তিনি ভোরের ডাককে বলেন, একদিকে নানামুখী অস্থিরতা, সংশয়, নিরাপত্তাহীনতা অন্যদিকে রাজনৈতিক অনৈক্য, এর মধ্যে সরকার আদৌ অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারবে কি না তা নিয়ে জনগণের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে।
এদিকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি ও উক্ত আদেশের ওপর আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যেই গণভোট আয়োজন করা, আগামী জাতীয় নির্বাচনে উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু করা, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, ফ্যাসিস্ট সরকারের সকল জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা, স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ দাবিতে গতকাল ঢাকায় বিক্ষোভ করেছে জামায়াতসহ বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক দল। জামায়াত ছাড়া ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলাম পার্টি, জাগপা ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি বিক্ষোভ করে।
তবে পিআর আন্দোলন জামায়াতের পরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রতারণা বলে মন্তব্য করেছেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, জনগণের গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র ও সংবিধানের পুনর্গঠনের প্রকৃত প্রশ্ন থেকে জাতীয় সংলাপ ও ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রক্রিয়াকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এ আন্দোলন। তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী জুলাই অভ্যুত্থানের আগে বা পরে কখনো সংস্কার আলোচনায় অংশ নেয়নি।
তারা কোনো বাস্তব প্রস্তাব, কোনো সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি কোনো প্রতিশ্রæতি দেয়নি। অবশ্য বিএনপি শুরু থেকে পিআর পদ্ধতির বিরুদ্ধে। এছাড়া জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের দিনই গণভোটের পক্ষে। তবে নভেম্বর মাসেই গণভোট চায় জামায়াতসহ আটটি ইসলামী রাজনৈতিক দল।
অন্যদিকে জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করেনি জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুথানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের নিয়ে গড়ে উঠা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এর পাশাপাশি বাম ধারার চারটি রাজনৈতিক দলও সনদে এখন পর্যন্ত স্বাক্ষর করেনি। দলগুলো হলো বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ।
জানা গেছে, দেশের নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বর্তমানে ৫৪টি হলেও সোমবার পর্যন্ত নিবন্ধিত ২০টি রাজনৈতিক দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে ২৬টি রাজনৈতিদক দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে বলে জানা গেছে।