ই-পেপার বাংলা কনভার্টার বৃহস্পতিবার ● ৩০ অক্টোবর ২০২৫ ১৪ কার্তিক ১৪৩২
ই-পেপার বৃহস্পতিবার ● ৩০ অক্টোবর ২০২৫
Select Year: 
ব্রেকিং নিউজ:




হরিপুর জমিদার বাড়ির ইতিহাস ও ঐতিহ্য
ফারজানা হক
প্রকাশ: শনিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫, ২:০৬ পিএম  (ভিজিটর : ১০১)
বাংলাদেশের উত্তরে অবস্থিত রংপুর বিভাগের ঠাকুরগাঁও জেলার একটি উপজেলা হল হরিপুর। হরিপুর উপজেলার সদরে অবস্থিত হরিপুর রাজবাড়ি। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা থেকে হরিপুর রাজবাড়ির দুরত্ব ৬৫ কিলোমিটার। 

হরিপুর উপজেলার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হরিপুর জমিদার বাড়ি।প্রচলিত তথ্য মতে, মুসলিম শাসনামলে আনুমানিক ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দে ঘনশ্যাম কুন্ডু নামক একজন ব্যবসায়ী এন্ডি কাপড়ের ব্যবসা করতে হরিপুরে আসেন।মেদনীসাগর গ্রামের মেহেরুন নেসা নামক এক মুসলিম মহিলা উক্ত অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। খাজনা অনাদায়ের কারণে মেহেরুন নেসার জমিদারির কিছু অংশ নিলাম হয়ে গেলে ঘনশ্যাম কুন্ডু সে জমিগুলো কিনে নেন। 

ঘনশ্যামের পরবর্তি বংশধরের একজন রাঘবেন্দ্র রায় ১৮৯৩ সালে হরিপুর রাজবাড়ির ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন এবং কাজ শুরু করেন। কিন্তু তিনি রাজবাড়ির কাজ সমাপ্ত করতে পারেননি। রাঘবেন্দ্র রায়ের মুত্যুর পর তার পুত্র জগেন্দ্র নারায়ণ রায় ঊনিশ শতকের শেষ দিকে রাজবাড়ির কাজ সমাপ্ত করেন। জগেন্দ্র নারায়ণ রায় বিভিন্ন রকম সামাজিক ও জনহিতকর কাজের জন্য ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ‘রাজর্ষি’ উপাধিতে ভূষিত হন। 

জগেন্দ্র নারায়ণ রায় সমাপ্তকৃত রাজবাড়ির পূর্ব দেয়ালে জগেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর চৌদ্দটি আবক্ষ মূর্তির প্রতিকৃতি রয়েছে। ১৯১১ সালে ইংরেজ সম্রাট পঞ্চম জর্জের ভারত আগমনের স্মারক হিসেবে জগেন্দ্র নারায়ণ রায় তার ১৪টি আবক্ষ মূর্তি নির্মাণ করেন। এছাড়াও রাজবাড়ির দ্বিতল ভবনে লতাপাতা, ফুল, বিভিন্ন মূর্তির প্রতিকৃতি ও নকশা রয়েছে। তবে সময়ের ব্যবধানে বর্তমানে নকশা ও প্রতিকৃতিগুলো প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।রাজবাড়ির মূল ভবনের সিংহ দরজাটাও সময়ের ব্যাবধানে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। 

রাজর্ষি জগেন্দ্র নারায়ণ রায় ছিলেন একজন বিদ্যানুরাগী, শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চার ব্যাপারে আগ্রহী ব্যক্তি। তিনি রাজবাড়ি তৈরি করার সময় রাজবাড়ির ভেতরে একটা বড় পাঠাগার তৈরি করেছিলেন। যার অস্তিত্ত্ব এখন নেই। রাজবাড়ির মূল ভবনটির পূর্বপাশে রয়েছে ৪০০ বছরের পুরোনো টেরাকোটার নকশাকৃত একটি শিব মন্দির ও শিব মন্দিরের সামনেই রয়েছে একটা নাট মন্দির। জোড় বাংলা পদ্ধতিতে তৈরি শিব মন্দিরটি। শিব মন্দিরের ছাদ অনেকটা ছাতা আকৃতির ও আটচালা বিশিষ্ট এবং দেয়ালগুলো আট কোণ বিশিষ্ট। 

মন্দিরের দক্ষিণে একটা দরজা এবং পূর্ব-পশ্চিমের দেওয়ালে একটি ক্ষুদ্রাকৃতির জানালা আছে। মন্দিরের দেওয়ালে বিভিন্ন মূর্তির নকশা ও লতাপাতার নকশা রয়েছে। বর্তমানে মন্দিরটির ছাদ প্রায় ধ্বংসের পথে।সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে গেছে মন্দিরের দৃষ্টি নন্দন কারুকার্য খচিত প্রাচীন টেরাকোটা নকশাগুলো। এই পুরাতন শিব মন্দিরের সামনে পরবর্তিতে নতুন একটি শিব মন্দির তৈরি করা হয়েছে।৩ একর ২৭ শতক জমির উপর নির্মিত এই জমিদার বাড়িটিতে জমিদারি পরিচালনার জন্য কাচারী, ধর্মীয় উংসবের জন্য বিভিন্ন উপাসনালয়, বিনোদনের জন্য নাচমহল, অন্দরমহল, নাগমহল, পাঠাগার ও অন্ধকূপ নির্মাণ করা হয়েছিল।

১৯০৩ সালে ঘনশ্যামের বংশধররা বিভক্ত হয়ে গেলে হরিপুর রাজবাড়িটি দুটি অংশে বিভক্ত করা হয়। রাঘেবেন্দ্র রায় ও জগেন্দ্র নারায়ণ রায় নির্মিত রাজবাড়িটি বড় তরফের রাজবাড়ি নামে পরিচিত। পরবর্তিতে বড় তরফ থেকে জমিদার জগেন্দ্র নারায়ণের দুই ছেলে রবীন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ও বিশ্বেন্দ নারায়ণ রায় চৌধুরী জমিদারি পরিচালন করতেন। উক্ত রাজবাড়ির পশ্চিমদিকে রমেন্দ্র কৃষ্ণ রায় চৌধুরী ও গিরিজা বল্লভ রায় চৌধুরী ১৯০৩ সালে আরেকটি রাজবাড়ি তৈরি করেন যার নাম ছোট তরফ। 

রমেন্দ্র রায় ছিলেন ঘরকুনো স্বভাবের। কিন্তু গিরিজা বল্লভ রায় ছিলেন আমুদে প্রকৃতির। তিনি ছিলেন নাচ, গান ও ক্রীড়ানুরাগী। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তারা ভারতে চলে যান। এরপর দীর্ঘদিন এই জমিদার বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে। ১৯৭৩ সালে প্রথম এই জমিদার বাড়িটি সংস্কার করেন বাংলাদেশ সরকার। এরপর দীর্ঘ দিন জমিদার বাড়িটি অযত্ন আর অবহেলায় দাঁড়িয়ে ছিল। ২০১৯ সালে করোনা মহামারির সময় নিজ উদ্যোগে পরিষ্কার করে স্থানীয় শিশু, কিশোর, যুবকরা। জমিদার বাড়িটি সংস্কারের দাবীতে সে সময় মানববন্ধন ও করা হয়েছিল। 

এছাড়াও শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে  বাড়িটির গুরুত্ব তুলে ধরে লিফলেটও বিতরণ করা হয়েছিল। কিন্তু তখন কোন সংস্কার কাজ হয়নি। দীর্ঘদিন সংস্কার কাজ না করায় ২০২০ সালের ভারী বর্ষণের ফলে জমিদার বাড়ির কিছু অংশ ভেঙ্গে পড়ে। সেই বছরের ১৫ জুলাই এলাকাবাসী ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়িটি সংস্কার ও সংরক্ষণের দাবিতে মানববন্ধন করেন। ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর থেকে পুনরায় শুরু করা হয় জমিদার বাড়িটির সংস্কারের কাজ।তৎকালীন জমিদার বাড়ির দেয়ালে ঝোলানো সাইনবোর্ডে লেখা ছিল, “গ্রামীন অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচির আওতায় প্রথম ধাপে হরিপুর জমিদার বাড়ি ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে সংস্কার কাজ চলছে”। 

সেসময় বাড়ির দেওয়ালে শেওলা আর জঙ্গল উপড়ে ফেলে দেওয়া হয় রঙের প্রলেপ। বর্তমানে পরিত্যক্ত বাড়িটিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে বেশ কিছু পরিবার।দীর্ঘদিন জমিদার রাজবাড়িটির বিভিন্ন কক্ষে স্থানীয় মহিলা সমিতি, ভূমি অফিসার্স সমিতি সহ বিভিন্ন সংগঠনের অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমানে জমিদার বাড়িটি সংস্কার করা হচ্ছে বলে অফিসগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

এক শতাব্দীরও বেশি পুরোনো এই অট্টালিকাটির দৃষ্টিনন্দন কারুকাজের বিলুপ্তপ্রায় নিদর্শন গুলো প্রাচীনতত্ত্বের বিবেচনায় খুব মূল্যবান না হলেও এ অঞ্চলের একটি আকর্ষণীয় স্থাপত্য কীর্তি হিসেবে এখনও মানুষকে কাছে টেনে নিয়ে যায়। হরিপুরের সমাজ প্রবর্তন ও ইতিহাসের একমাত্র কালের সাক্ষী এই জমিদার বাড়িটি।এই জমিদার বাড়িটি সংরক্ষণ করার মাধ্যমে জমিদার বাড়ির শাসনামল, সাংস্কৃতিক ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংগ্রাম, সে সময়ে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন, নৈতিকতা, সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা সহজ হবে এবং এটাকে উত্তরবঙ্গের অন্যতম পর্যটন স্থান হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়







সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক : কে.এম. বেলায়েত হোসেন
৪-ডি, মেহেরবা প্লাজা, ৩৩ তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত এবং মনিরামপুর প্রিন্টিং প্রেস ৭৬/এ নয়াপল্টন, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
বার্তা বিভাগ : ৯৫৬৩৭৮৮, পিএবিএক্স-৯৫৫৩৬৮০, ৭১১৫৬৫৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন ঃ ৯৫৬৩১৫৭, ০১৭১২-৮৮৪৭৬৫
ই-মেইল : bhorerdakonline@gmail.com, adbhorerdak@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
বার্তা বিভাগ : ৯৫৬৩৭৮৮, পিএবিএক্স-৯৫৫৩৬৮০, ৭১১৫৬৫৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন ঃ ৯৫৬৩১৫৭, ০১৭১২-৮৮৪৭৬৫
ই-মেইল : bhorerdakonline@gmail.com, adbhorerdak@gmail.com