ই-পেপার বাংলা কনভার্টার বৃহস্পতিবার ● ৩০ অক্টোবর ২০২৫ ১৪ কার্তিক ১৪৩২
ই-পেপার বৃহস্পতিবার ● ৩০ অক্টোবর ২০২৫
Select Year: 
ব্রেকিং নিউজ:




সাবেক আইজিপির রাজসাক্ষ্যে বৈশ্বিক মানবাধিকার প্রশ্ন
হামিম হাফিজুল্লাহ্ শেফা
প্রকাশ: বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ৫:৪৩ পিএম  (ভিজিটর : ২২৪)
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বহু বিতর্কিত অধ্যায় রয়েছে। তবে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের সাম্প্রতিক জবানবন্দি দেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহারের প্রশ্নে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-০১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন প্যানেলে তিনি রাজসাক্ষী হিসেবে যে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন, তা আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

মামুন বলেন, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগের রাতে পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা ও তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সরাসরি পরামর্শ দিয়েছিলেন- “৫০ শতাংশ ভোট আগেই ব্যালট বাক্সে ভরে রাখতে।” এ মন্তব্য শুধু নির্বাচনের স্বচ্ছতা নয়, দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।

তিনি ট্রাইব্যুনালে আরও জানান, জুলাই আন্দোলনের সময় আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র ব্যবহার, হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো এবং বøক রেইড পরিচালনার মতো চরম সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল রাজনৈতিকভাবে। এই সিদ্ধান্তের মূল নির্দেশ এসেছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে। মামুনের বক্তব্যে উঠে আসে, তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিব এবং ডিবির হারুন ছিলেন মারণাস্ত্র ব্যবহারে অতিউৎসাহী।

মামুনের জবানবন্দিতে উঠে আসে র‌্যাবের ভেতরে গড়ে ওঠা গোপন বন্দিশালার ভয়ঙ্কর চিত্র। তিনি বলেন, “র‌্যাব-১ এ ‘টিআইএফ’ নামে একটি গোপন বন্দিশালা ছিল। অন্যান্য র‌্যাব ইউনিটেও একই ধরনের বন্দিশালা স্থাপন করা হয়েছিল।” সরকারবিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী, কর্মী এবং ভিন্নমতের নাগরিকদের এখানে এনে অমানবিকভাবে আটক রাখা হতো। অনেককে “আয়নাঘরে” রেখে মানসিক নির্যাতন করা হতো। আবার অনেককে তথাকথিত “ক্রসফায়ার” দেখিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।
তিনি উল্লেখ করেন, এসব অপারেশনের সরাসরি নির্দেশ আসতো প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে। কখনো এসব নির্দেশনা দিতেন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারেক সিদ্দিকী।

চাঞ্চল্যকর আরেকটি দিক হলো পুলিশের ভেতরে গড়ে ওঠা কথিত “গোপালগঞ্জ সিন্ডিকেট।” মামুন দাবি করেন, এ সিন্ডিকেট শুধু পুলিশ প্রশাসনেই নয়, গোটা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এককেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণে এনে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে। এর ফলে পেশাদারিত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং পুরো বাহিনী জনআস্থা হারিয়েছে।

চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন চলতি বছরের ২৪ মার্চ মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তিনি জানান, তিনি স্বেচ্ছায় আসামি থেকে রাজসাক্ষী হয়ে সত্য উন্মোচন করতে চান। তার মতে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নির্দেশ পালনে বাধ্য হয়ে বহু বেআইনি কর্মকাÐ ঘটেছে, যা এখন প্রকাশ করা তার নৈতিক দায়িত্ব।
মামুনের জবানবন্দি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (ঐজড) জানিয়েছে, “সাবেক আইজিপির এই স্বীকারোক্তি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে যে গভীর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে, তার একটি প্রমাণ। ভিন্নমতের নাগরিকদের গোপনে আটকে রাখা ও হত্যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের শামিল।”

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে বলেছে, “এটি কেবল জাতীয় রাজনীতির নয়, বরং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের জন্যও একটি উদ্বেগজনক সংকেত। যারা গুম, হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের পরিবার এখনো ন্যায়বিচারের অপেক্ষায়।”

জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয় (ঙঐঈঐজ) এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি বলেছে, “বাংলাদেশ সরকারের উচিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করে এসব অভিযোগের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করা। ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হলে আন্তর্জাতিক আদালতে বিষয়টি গড়াতে পারে।”

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরও এ ঘটনাকে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি আখ্যা দিয়ে নির্বাচনকালীন স্বচ্ছতা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কোনো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। কিন্তু সাবেক আইজিপি মামুনের জবানবন্দি দেখায়, এ বাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হলে তা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এসব কেবল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকেই নির্দেশ করে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

সাবেক আইজিপি মামুনের রাজসাক্ষ্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন প্রশ্ন তুলেছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার শুদ্ধি এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পেশাদারিত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পর্যবেক্ষণ প্রমাণ করে, বিষয়টি কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নয়-এটি একটি বৈশ্বিক মানবাধিকার প্রশ্ন।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, অর্থ বাণিজ্য বার্তা







সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক : কে.এম. বেলায়েত হোসেন
৪-ডি, মেহেরবা প্লাজা, ৩৩ তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত এবং মনিরামপুর প্রিন্টিং প্রেস ৭৬/এ নয়াপল্টন, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
বার্তা বিভাগ : ৯৫৬৩৭৮৮, পিএবিএক্স-৯৫৫৩৬৮০, ৭১১৫৬৫৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন ঃ ৯৫৬৩১৫৭, ০১৭১২-৮৮৪৭৬৫
ই-মেইল : bhorerdakonline@gmail.com, adbhorerdak@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
বার্তা বিভাগ : ৯৫৬৩৭৮৮, পিএবিএক্স-৯৫৫৩৬৮০, ৭১১৫৬৫৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন ঃ ৯৫৬৩১৫৭, ০১৭১২-৮৮৪৭৬৫
ই-মেইল : bhorerdakonline@gmail.com, adbhorerdak@gmail.com