রাজধানী পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ । সম্প্রীতি কলেজটিতে বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবারের এইচএসসি'র ফলাফলে ধস নেমেছে। এ বছর কলেজটির গড় পাসের হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬৭.৭২ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় অনেক কম। সব বিভাগ মিলিয়ে (বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা) জিপিএ-৫ পেয়েছে মাত্র ৪ জন শিক্ষার্থী।
বৃহস্পতিবার(১৬ অক্টোবর) এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর দেখা যায় যে, সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় মোট অংশগ্রহণ করেছিল ২১২৫ জন। এর মধ্যে পরীক্ষা দিয়েছে ২০২৯ জন এবং পাস করেছে ১৩৭৪ জন, যার পাসের হার ৬৭.৭২ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছে মাত্র ৪ জন।
এর মধ্যে ব্যবসা বিভাগ থেকে পাস করেছে ৬১৪ জন, ফেল করেছে ২১৯ জন। জিপিএ ৫ পেয়েছে একজন। মানবিক বিভাগ থেকে পাস করেছে ৪৯৪ জন,ফেল করেছে ৪৬৩ জন। জিপিএ ৫ কেউ পায় নি। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করেছে ২৬৬ জন, ফেল করেছে ৮৯ জন, জিপিএ ৫ পেয়েছে ৩ জন।
এদিকে ২০২৪ সালে প্রতিষ্ঠানটিতে পাসের হার ছিল ৮০.০৯ শতাংশ এবং জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৪২ জন। জিপিএ ৫ প্রাপ্তদের মধ্যে ব্যবসায় শিক্ষা থেকে ৫ জন এবং বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ ৩৩ জন ও মানবিক বিভাগ থেকে পেয়েছিলেন ৪ জন। ২১২৫ জন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পাস করেছিলেন ১৭০২ জন। অর্থাৎ অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪২৩ জন।
অন্যদিকে ২০২৩ সালে সোহরাওয়ার্দী কলেজের পাসের হার ছিল ৮০.৪৪ শতাংশ এবং জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৮ জন। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪০৬ জন। ২০২২ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সোহরাওয়ার্দী কলেজের পাসের হার নেমে আসে ৮৭.৬৮ শতাংশ এ এবং জিপিএ ৫ পায় ১১৯ জন। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২৪ জন।
২০২১ সালের (সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে অনুষ্ঠিত) উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হার ছিল এসে ৯৬.৭৩ শতাংশ এবং জিপিএ ৫ পায় ৯৫ জন।অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০১ জন।
এবছর পাসের হার দাঁড়িয়েছে ৬৭.৭২ শতাংশ, এবং জিপিএ পেয়েছে মাত্র ৪ জন, যা সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। এমন বিপর্যয়ের পিছনে সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা কলেজ প্রশাসনের তদারকির অভাবকেই দায়ী করছেন। অপর দিকে এর পেছনে নানা কারণ দায়ী করছে কলেজের উপাধ্যক্ষ, শিক্ষক এবং সিনিয়র শিক্ষার্থীরা।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানান, ঐতিহ্যবাহী এমন একটি কলেজ থেকে এই বছর ২০২৯ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করে ১৩৭৪ জন এবং জিপিএ-৫ কিভাবে মাত্র ৪ জন পাই এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। যেখানে ঢাকা কলেজ থেকে ১১৩৮ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করে ১১২৭ জন এবং জিপিএ-৫ পাই ৭৫৫ জন, সেখানে সোহরাওয়ার্দীতে মাত্র ৪ জন! ঢাকা কলেজের শিক্ষকরাও বিসিএস ক্যাডার, এখান কার শিক্ষকরাও বিসিএস ক্যাডার। তারও যে সুযোগ -সুবিধা পাই এখান কার শিক্ষকরাও একই সুযোগ -সুবিধা পাই। তাহলে কলেজ প্রশাসন কি করে? এখানে লেখাপড়ার মান দিন দিন তাহলে কি হারিয়ে যাচ্ছে?
এই বিষয়ে পাসকৃত এক শিক্ষার্থী বলেন, কলেজ কতৃপক্ষের গাফিলতিই হলো প্রধান কারন। ছাত্রছাত্রীরা কলেজের নাম করে বাইরে আড্ডা দেয়, সিগারেট খাই , মেয়েদের নিয়ে ঘোরাঘুরি সহ আরো কত কি। কিন্তু এই বিষয়ে প্রশাসনের কোনো নজরদারিই নেই । অথচ অন্যান্য সরকারি কলেজে ১ দিনের পরে ২ দিন অনুপস্থিত থাকলেই বিষয়টা অভিভাবককে জানানো হয়। কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়। যারা ভালো রেজাল্ট করছে তারা একান্ত নিজের চেষ্টায় করছে।
এই বিষয়ে সিনিয়র শিক্ষার্থীরা বলেন, কলেজ প্রশাসনই একমাত্র দায়ী, কারণ তারা ছাত্র- ছাত্রীদের পড়াশোনার প্রতি কোনো চাপ সৃষ্টি করে না। যেখানে ক্লাসে বসতে পারে ১০০ জন, সেখানে ভর্তি নেয় ৮০০ থেকে ১০০০ জনের অধিক।
সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীদের ভাবনায় বিশ্ব শিক্ষক দিবসসোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীদের ভাবনায় বিশ্ব শিক্ষক দিবস
ফলাফল প্রকাশের পর শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা ও উদ্বেগ। ফলাফল নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও শিক্ষার্থীদের হতাশা প্রকাশ পেতে দেখা গেছে। অনেকেই কলেজের শিক্ষার মান ও ক্লাসের নিয়মিততা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
মানবিক বিভাগের এক শিক্ষার্থী জানান, আমাদের সব বিষয়েই অপর্যাপ্ত ক্লাস হয়েছে। প্রত্যেকটা ক্লাসে শিক্ষকরা ম্যারাথন ক্লাস করাইছে। কোন বিষয় পুরোপুরি ভাবে বুঝতে পারেনি। আমাদের কোন টপিক পুরোভাবে ক্লিয়ার না করে অন্য টপিকে যাওয়ায় আমাদের সমস্যা হয়েছে। এছাড়াও আমাদের সাথে সিভিল ড্রেসে অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও কলেজের এডমিট কার্ড নিয়ে অংশগ্রহণ নেয়ায় আমাদের রেজাল্ট খারাপ হতে পারে। কারণ তারা তো কখনো ক্লাস করে নাই শুধু কলেজের এডমিট কার্ড নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছে।
বিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থী জানায়, আমাদের কলেজের ডিসিপ্লিন ঠিকমতো নাই। যে যার মতো চলাফেরা করে। আমাদের কিছু কিছু বিষয়ে শিক্ষক সংকট রয়েছে। আমাদের নিয়ম মতো পড়াইতে পারে না। আমাদের বিজ্ঞানের ইন্সট্রুমেন্টের কিছু সংকট রয়েছে। এছাড়াও আমাদের কলেজ থেকে পড়াশোনায় গ্যাপ থাকা শিক্ষার্থীরাও পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেছে। তাই রেজাল্ট বেশি খারাপ হয়েছে।
এদিকে সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কাকলী মুখোপাধ্যায় অসুস্থও ছুটিতে থাকায় এই বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে কলেজটির উপাধ্যক্ষ ড.ফরিদা ইয়াসমিন জানান, এই বিষয়টা আমাকে অনেক আহত করেছে। তারা নিয়মিত ক্লাসে আসে না মূলত এই জন্যই রেজাল্ট খারাপ বেশি হয়েছে। নিয়মিত ক্লাস করলেই বিপর্যয় আর কি হইতো না। আমি টিচারদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি সব সময়, যে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের কিভাবে আনা যায়।আমি ওদের ওয়াদা করেয়েছি। যে তোমরা ক্লাসে আসো,বন্ধু যাদের আছে তাদের কে নিয়ে আসো। আমি ওদেরকে মোটিভেট করার চেষ্টা করি।গনিতে কিছু শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে আবার আমাদের বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর শিক্ষকও কম আবার ইন্সট্রুমেন্টের কিছু ঘাটতি রয়েছে। এগুলো আমরা ঠিক করার চেষ্টা করছি।