দীর্ঘদিনের বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের ভূমিকা নিয়ে জাতির কাছে শর্তহীনভাবে ক্ষমা চেয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিতর্কিত ভূমিকা এবং ১৯৪৭ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত তাদের বা সংগঠনের কোনো সদস্যের কর্মকান্ডে কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে, তার জন্য পূর্ণ দায় স্বীকার করে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা চেয়েছেন। পাশাপাশি সেসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছে জামায়াত।
একই সঙ্গে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে জামায়াতপ্রধান বলেন, রোজার আগেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে-- এ নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় জনগণের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, পিআর পদ্ধতি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে গণভোট আয়োজনের মাধ্যমে জনমত যাচাই করা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত। সংখ্যালঘুসহ দেশের সব নাগরিক যেন নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে ভোট দিতে পারেন-- সেটিই আমাদের প্রত্যাশা। সপ্তাহব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রথম দিন নিউ ইয়র্কের স্থানীয় সময় গত বুধবার সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে তিনি দলের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থানের কথা স্পষ্ট করেন।
একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে জামায়াতের অবস্থান
নিউ ইয়র্কে আন্তর্জাতিক সংলাপ ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার অংশ হিসেবে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি একাত্তরের দায় স্বীকার করে বিনা শর্তে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। জামায়াত আমির স্বীকার করেন যে, “একাত্তরে জামাতের কোনো ভূমিকা ছিল না? অবশ্যই ছিল। জামায়াত তখন ফিল করেছিল যে, পাকিস্তান ইউনাইটেড থাকা দরকার।
তখনও কিন্তু পাকিস্তান; আওয়ামী লীগের বহু লিডার পাকিস্তান সরকারের আন্ডারে চাকরি করেছে, বেতন নিয়েছেন। এমনকি আওয়ামী লীগের লিডার পরিবারের অনেকে তৎকালীন পাকিস্তানের সরকারের রেশন নিয়েছে। বেনিফিট নিয়েছে। আমাদের কোনো আপত্তি নাই। বিপদের সময় এটা সরকারের দায়িত্ব; নাগরিকদেরকে দেখা- দেখেছে। সে কোন দলের, এটা আমাদের দেখার ব্যাপার না। সেগুলো বাস্তবতা।
তিনি দাবি করেন, একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের ‘প্রায় ৯০ ভাগ জায়গায়’ পাকিস্তানের পতাকা উড়েছে। অফিস-আদালতে পাকিস্তানের নামে সবাই চাকরি করেছে। ১৫ তারিখ থেকে এই সিনারি পুরাপুরি চেঞ্জ হয়ে গেছে। পরবর্তী দুই দিনে ওই পতাকাও নেমে গেছে। চাকরিও বন্ধ হয়ে গেছে। এর আগ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে যারাই কাজ করেছেন, তারা পাকিস্তানকে মেনে নিয়ে কাজ করেছে। এখন এটা বলতে পারেন জনপ্রত্যাশার বিরুদ্ধে, জনপ্রত্যাশা ছিল যে পাকিস্তানের শাসকরা চলে যাক। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাক। জামায়াত এটাকে সম্মান করল না কেন? এটা একটা লেজিটিমেট কোশ্চেন।
করলে ভালো হত, করা উচিত ছিল; এ ব্যাপারে আমার কোনো দ্বিমত নাই। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, শুধু একাত্তর নয়, ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত তাদের দ্বারা যে যেখানে যত কষ্ট পেয়েছেন, জামায়াত তার জন্য বিনা শর্তে মাফ চাইছে। তিনি বলেন, “আমরা মানুষ, ভুল আমাদেরও হয়, ভুল করি নাই-- এমন দাবি করার অধিকার আমাদের নেই।” তিনি জানান, ইতিপূর্বে অধ্যাপক গোলাম আজম এবং মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীও জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন, এবং তিনি নিজেও গত ২৭ মে যুদ্ধাপরাধের মামলায় দলের নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম খালাস পাওয়ার পর অনুরূপ ক্ষমা চেয়েছিলেন।
নির্বাচন ও রাজনৈতিক সংস্কার
আসন্ন জাতীয় নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে জামায়াতপ্রধান কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেন। ডা. শফিকুর রহমান বলেন, রোজার আগেই (ফেব্রুয়ারি মাসে) জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এ নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় জনগণের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি পিআর পদ্ধতি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে গণভোট আয়োজনের মাধ্যমে জনমত যাচাইয়ের দাবি জানান। তার ভাষ্য, “আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।” এর বাইরে তিনি প্রত্যাশা করেন, সংখ্যালঘুসহ দেশের সব নাগরিক যেন নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে ভোট দিতে পারেন। জামায়াত ক্ষমতায় গেলে সাংবিধানিক অধিকার অনুযায়ী সংখ্যালঘুরা নির্বিঘ্নে থাকবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক হবে ‘মিউচুয়াল রেসপেক্ট’
দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং বিএনপির সঙ্গে টানাপড়েন নিয়েও তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে জামায়াত আমির বলেন, “মানুষ নিজের তার জায়গা শিফট করতে পারে; কিন্তু প্রতিবেশী পাল্টাতে পারে না।” তিনি প্রতিবেশীকে সম্মান করতে চান এবং একইভাবে প্রতিবেশীর কাছ থেকে পাওনা সম্মানটুকুও চান। এই সম্পর্ক হতে হবে ‘মিউচুয়াল রেসপেক্টের’ ভিত্তিতে। তিনি সমতার কথা অস্বীকার করে বলেন, ভারত বাংলাদেশের চেয়ে ২৬ গুণ বড়। তাই তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বাংলাদেশের ১১৮ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই ছোট্ট ভূখন্ডকেও তাদের সম্মান করতে হবে।
তিনি বলেন, “আমরা তাদেরকে তাদের জায়গায় সম্মান করতে চাই। কিন্তু আমাদের যে ছোট্ট একটি ল্যান্ড আছে, আর ১১৮ মিলিয়ন পপুলেশন আছে, এটাকেও তাদের রেসপেক্ট করতে হবে। দিস ইজ আওয়ার ডিমান্ড। যদি এটা হয়, তাহলে দুই প্রতিবেশী শুধু ভাল থাকব না, এক প্রতিবেশীর কারণে আরেক প্রতিবেশী বিশ্ব দরবারেও সম্মানিত হব। যুক্তরাষ্ট্র সফরে মার্কিন প্রশাসনের নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনা আছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি কেবল বলেন, “সেটি সিক্রেট।
বিএনপির সঙ্গে টানাপোড়েন
প্রায় দুই যুগ ধরে চলা বিএনপির সঙ্গে জোট ভেঙে যাওয়ার প্রসঙ্গে জামায়াত আমির বলেন, জামায়াত ও বিএনপি দুটি পৃথক দল এবং জাতীয় প্রয়োজনে আমরা বহুদিন একসাথে ছিলাম। তিনি জানান, জামায়াত এখন কোনো দলকেই স্পেসিফিক টার্গেট করে কথা বলে না, বরং নীতিগত কথা বলে। তিনি ৫ আগস্টের পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করার অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করে বলেন, জাতির ক্ষতি হয় এমন কিছু ধরা পড়লে প্রথমে গোপনে বলবেন, আর তা বন্ধ না হলে রাস্তায় নামতে বাধ্য হবেন তবে কারো নাম নেবেন না।
ডা. শফিকুর রহমান জোর দিয়ে বলেন, “আমরা যদি সুযোগ পাই এটা বাংলাদেশ হবে, ইনশাআল্লাহ। এটা অন্য কোনো দেশ হবে না।” তিনি দেশের বিভেদ সৃষ্টিকারী ‘মেজরিটি-মাইনোরিটি’ ধারণা পরিহার করে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। কোয়ালিশন অব বাংলাদেশি আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন- কোবা আয়োজিত ওই মতবিনিময় সভা সঞ্চালনা করেন জামায়াতে ইসলামের যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়কারী নাকিবুর রহমান।
কুইন্সের ওয়ার্ল্ড ফেয়ার মেরিনা পার্টি হলে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন জামায়াত আমির। তবে আগামী ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় নিউ ইয়র্কে প্রবাসীদের এক সমাবেশে জামায়াত আমির বক্তৃতা করবেন বলে জানান দলের যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়কারী নাকিবুর রহমান। অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর অনুসারী প্রবাসীরাও উপস্থিত ছিলেন।