আমাদের সাগর-পাহাড় ঘেষা মিয়ানমারের রাখাইন হতে যাচ্ছে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র। চলতি মাসেই সরকারি বাহিনীকে পরাজিত করে রাখাইনে নব্বই অঞ্চলের দখল নিয়েছে রাজ্যটির সশস্ত্র বিদ্রোহী বাহিনী আরাকান আর্মি। এতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যকে ঘিরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর এখন দক্ষিণ এশিয়ায়।বাংলাদেশের কাছে নতুন রূপে আর্বিভূত হতে যাচ্ছে ভূ-রাজনৈতিক এক সংকট। কক্সবাজার সীমান্তের ওপাড়ে যেকোনো মুহুর্তে হতে পারে নতুন একটি রাষ্টের ঘোষণা। ফলে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের অস্থিরতার মধ্যেই আরও বড় সংকটে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
রাখাইনকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণার সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করেছে ভারত চীন আমেরিকার মতো দেশগুলো। এতে প্রশ্ন উঠেছে, ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কি নতুন সংকটে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই নতুন সমীকরণে কতটা স্বস্তিকর হবে ঢাকার জন্য? এই নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষন। এমন খবরই উঠে আসছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতেও।
দেড় দশক আগে ২০০৯ সালের ১০ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয় এএ হল ইউনাইটেড লীগ অফ আরাকান (ইউএলএ) এর সামরিক শাখা আরাকার আর্মির। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিতে তারা তাদের কার্যক্রম শুরু করে। রাখাইন নৃগোষ্ঠীর (আরাকানি) বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের এই সংগঠন নিজেদের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে সামনে রেখে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় গোষ্ঠীটি। আর প্রতিষ্ঠার মাত্র দেড় দশকের কম সময়ে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীকে পরাজিত করে রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা। তাই দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এখন অনেকটাই নিশ্চিত।
এদিকে ভৌগলিকভাবে রাখাইনের অবস্থান ও সম্পদ চীন ও ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই রাখাইনকে নিজেদের বলয়ে রাখতে এশিয়ার দুই পরাশক্তি ভারত ও চীন এরই মধ্যে তাদের জাল বিস্তার করে ফেলেছে। কারণ, রাখাইনে আছে এই দুই দেশের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ।
কয়েক বছর আগে চীন রাখাইনের চকভিউতে গড়ে তুলেছে গভীর সমুদ্রবন্দর। বঙ্গপোসাগরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলায় রাখাইনের এই বন্দর চীনের মহাস্ত্র। এছাড়া এই বন্দর থেকেই সরাসরি গ্যাস যায় চীনে। দেশটির বেল্টেন্ড রোড ইনেসিয়েটিভ বাস্তবায়ন এবং মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায় তেল-গ্যাস পাঠানোর বিকল্প ও সহজ পথও এই অঞ্চলকে ঘিরে। এছাড়া মিয়ানমারের ইরাবতী নদীতে চীনের ১৩ হাজার মেগাওয়াটের এক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে।সবমিলিয়ে বহু বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে চীনের।
অন্যদিকে ভারতের জন্য রাখাইন মহাগুরুত্বপূর্ণ। কালাদান মেগা প্রজেক্টের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বাইপাস করে সেভেন সিস্টার ও কলকাতার মধ্যে ভারতের যোগাযোগ সহজ করতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে ভারত। এছাড়া সেভেন সিন্টারকে চীনের বিচ্ছিন্নকরণের হুমকি মোকাবিলায়ও রাখাইন ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কালাদান মিয়ানমারের নদীর নাম। যা রাখাইন থেকে ভারতের অভ্যন্তরে গিয়েছে। ভারত এই পথে কেন্দ্র থেকে তার সেভেন সিস্টার ও কলকাতার মধ্যে সহজ পথ গড়তে বিনিয়োগ করেছে। এপথে মিয়ানমার থেকে পাইপ লাইনে গ্যাসও নেবে ভারত।
অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদেশগুলোর কাছেও রাখাইন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিয়ে আছে। এশিয়ার এই অঞ্চলের প্রভাব ও বাণিজ্যিক পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাখাইনের বিকল্প নেই তাদের কাছে। যুক্তরাষ্ট্রর নজর বাংলাদেশ এবং রাখাইনের উপকূল জুড়ে। এই বৃহৎ সাগর সীমানায় চীনের প্রভাব দমনের বিষয়টি তাদের মাথা ব্যথার কারণ। এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, রাখাইন নিয়ে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির যে নতুন সমীকরণ শুরু হয়েছে তাতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও অবস্থান কি হবে?
মিয়ানমারের সরকার ও আরাকান আর্মি দুপক্ষের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক আছে ভারত ও চীনের। আরাকান আর্মির হাতে যত অস্ত্র তার সবই চীনের তৈরি। আবার কালাদানে চলমান প্রকল্পের জন্য ভারত আরাকান আর্মিকে মোটা অংকের চাঁদা দিয়ে চলে। নতুন রাষ্ট্র গঠন হলেও এই দুই দেশের তেমন প্রভাব পড়বে না। তবে নতুন রাষ্ট্র গঠিত হলে চাপ বাড়বে বাংলাদেশের।
সীমান্ত থাকলেও প্রতিবেশি মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও বাণিজিক সম্পর্ক একেবারেই সীমিত। স্পর্শকাতর রোহিঙ্গা ইস্যু, সমুদ্রসীমা বিরোধ মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর বাংলাদেশের আকাশ ও সমুদ্রসীমা লঙ্ঘন, পাবর্ত্য অঞ্চলকে নিজেদের বলে দাবি করার মতো বহু কারণে দুই দেশের সম্পর্কও বরফ শীতল।
এছাড়া নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে কার্যত হাত গুটিয়ে নিয়েছে ভারত ও চীন। ফলে শরনার্থী রোহিঙ্গারা নতুন সংকট হিসেবে আর্বিভূত হতে যাচ্ছে। জানা গেছে, রোহিঙ্গা ও আরাকান আর্মির মধ্যে বিরোধ বহু পুরানো। এছাড়া গত কয়েক মাস আগে চলা সংঘাতে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বাহিনীর পক্ষে রাখাইনের বেশ কিছু রোহিঙ্গা অংশগ্রহণ করে। এতে ওইসব রোহিঙ্গারা আরাকান আর্মির কাছে রাজাকার হিসেবে চিন্হিত। ফলে রাখাইনকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে আরাকান আর্মি সরকার গঠন করলে সীমান্তের ওপাড়ে থাকা ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গার বাংলাদেশে ঢল নামারও শঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। এছাড়া বাংলাদেশে অবস্থান নেয়া বারো লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার ফেরত যাওয়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশকে এখন তিনটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। প্রথমত, রাখাইনের সঙ্গে আমাদের পাবর্ত্য চট্টগ্রামসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রশ্নটি জড়িত। যে কারণে, ভারত প্রথম থেকেই রাখাইনের স্বাধীনতার ব্যাপারে নিরুত্তাপ থেকেছে। দ্বিতীয়ত, স্বাধীন রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি কী দাঁড়াবে? রোহিঙ্গাদের একটি অংশ ইতোমধ্যে ইচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে সামরিক জান্তার সঙ্গে যোগ দিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল। মংডু সেনা ছাউনি পতনের পর তারাও আটক বা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। তৃতীয়ত, রাখাইনের স্বাধীনতা বা কনফেডারেশন কতটা টেকসই হবে? যদি মিয়ানমার জান্তা রাখাইন পুনর্দখল করে নিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে তার কী প্রভাব পড়বে?
এই প্রশ্নও এখন তোলার সময় এসেছে, রাখাইন প্রশ্নে বাংলাদেশের নীতি আসলে কী? গত এক বছর ধরে যখন আরাকান আর্মি ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছিল, তখন আমরা কী করেছি? মিয়ানমারের প্রতিটি প্রতিবেশী নৃগোষ্ঠীগত নৈকট্যের সূত্র ধরে সেখানে তাদের ‘স্টেক’ তৈরি করে রেখেছে। বাংলাদেশ সেটা কতটা করেছে বা করতে পেরেছে?
বস্তুত রাখাইনের অভূতপূর্ব পরিস্থিতি বাংলাদেশের সামনে একটি পরীক্ষা ছুড়ে দিয়েছে। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীতে এসে আমাদের কূটনীতি, প্রতিরক্ষা ও ভূ-রাজনীতি কতটা পরিণত হয়েছে, রাখাইন স্বাধীনতার প্রশ্নটির সম্ভাব্য উত্তরপত্রের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হবে।
লেখক : সাংবাদিক।
ঢাকা, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪