গণমাধ্যমে প্রায়ই একটি শিরোনাম দেখতে পাই, হাসপাতাল আছে ওষুধ নাই। দেখা যায় দেশের জেলা উপজেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ থাকেনা। এসব হাসপাতালে সেবা নিতে যায় গরীব রোগীরা। যারা প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে অর্থ ব্যয় করে সেবা নিতে যেতে পারেনা। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে অতি প্রয়োজনীয় ওষুধও পাওয়া যায়না। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের মতো অত্যাবশ্যকীয় কিছু ওষুধ রয়েছে। বিশেষ করে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে কমবেশি সবাই যখন ঠাণ্ডাজনিত রোগে ভোগে, সেসব রোগীকে সারাতে এ ওষুধগুলো প্রয়োজন হয়। তবে এ সময় শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঠাণ্ডাজনিত রোগ সর্দি, কাশি, গলাফোলা, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া প্রভৃতিতে আক্রান্ত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়। এসব রোগের চিকিৎসায় হাসপাতালে সাধারণত নাপা ও প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধের প্রয়োগ করা হয়। সংবাদপত্রের খবর থেকে জানা যায়, বর্তমানে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ঠাণ্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। ২২ নভেম্বর হাসপাতালটির বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে ১ হাজার ৮৫৯ জন রোগী, যার মধ্যে ২৩০ জন শিশু। শিশুদের বেশির ভাগই সর্দি-কাশি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, জ্বর ও নিউমোনিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত। কিন্তু হাসপাতালটিতে রোগীর সংখ্যা বাড়লেও ঠাণ্ডাজনিত রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের পর্যাপ্ত জোগান নেই। একই অবস্থা দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা উপজেলায়।
জোগান না থাকার ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ওষুধ সরবরাহের জন্য দরপত্র কার্যক্রম শেষ হলেও ঠিকাদাররা এখনো ওষুধ সরবরাহ করেননি। ফলে শিশুদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এমনকি শিশুদের ওষুধ সংকটের পাশাপাশি অন্য রোগীদেরও ওষুধ সংকট রয়েছে। যদিও এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) মাধ্যমে কিছু সরকারি ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে, তবে তা পরিস্থিতি সামাল দিতে যথেষ্ট নয়।
সরকারি হাসপাতালগুলোতে ওষুধ সংকটের কারণে ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্তরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে রোগাক্রান্তদের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরো বাড়ছে। প্রয়োজনীয় ওষুধের অভাবে ঠাণ্ডাজনিত জটিলতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে হাসপাতালের চিকিৎসকরা রোগীদের বাইরের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কেনার পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু অধিকাংশ সময় বাইরের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে হলে বাড়তি দাম গুনতে হয় রোগীদের, যা চিকিৎসা বাবদ মানুষের পকেট ব্যয় বাড়ায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে যেখানে নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ অর্থকষ্টে দিন যাপন করছে, সেখানে ওষুধের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি হতাশাব্যঞ্জক।
তাছাড়া বাইরের ফার্মেসি থেকে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ কেনা কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। কেননা ওষুধ না থাকা দেশের একটি সরকারি হাসপাতালের স্বল্পমেয়াদি সমস্যা নয়। যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের বর্তমান পরিস্থিতি দেশের একাধিক সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরে। প্রায়ই ওষুধ সংকটের ঘটনা ঘটে। তাই দীর্ঘমেয়াদে সমস্যাটির সমাধান প্রয়োজন। ফার্মেসিগুলোয় ওষুধ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা আনয়ন, ওষুধ সরবরাহে স্বচ্ছতা নিশ্চিত এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা আবশ্যক। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর পদক্ষেপ এ সংকট থেকে উত্তরণ ও স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে।
দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো সরকারি হাসপাতাল। প্রধান ভিত্তি হওয়া সত্ত্বেও ওষুধের এমন সংকট কোনো পরিস্থিতিতেই কাম্য নয়। এখানে যথাসময়ে ওষুধ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটার অন্যতম একটি কারণ টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা ও সরবরাহকারীদের দায়িত্বহীনতা, যা যশোরের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্যেও উঠে এসেছে। এর বাইরে প্রধানতম কারণ হলো বাজেটের সীমাবদ্ধতা এবং তহবিল ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। সরকারি হাসপাতালগুলোর জন্য প্রায় সময় চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল বরাদ্দ দেয়া হয়। ফলে প্রয়োজনীয় ওষুধের পর্যাপ্ত মজুদ রাখা সম্ভব হয় না। তদুপরি বরাদ্দকৃত তহবিল যথাযথভাবে ব্যবহৃত না হওয়ায় এবং অসাধু সিন্ডিকেটের প্রভাবে সংকট তৈরি হয়। আবার অনেক সময় দেখা যায়, হাসপাতালগুলোর অভ্যন্তরীণ সুব্যবস্থাপনার অভাবে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধগুলো মজুদে থাকলেও তা যথাসময়ে রোগীদের সরবরাহ করা হয় না। অদক্ষ পরিচালনা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণে ওষুধ সংকট প্রকট হয়ে ওঠে। এসব দেখার কি কেউ নেই।
এ সংকট মোকাবেলায় জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রথমত ঋতু পরিবর্তনের বাস্তবতায় ঠাণ্ডাজনিত রোগের ওষুধের দ্রুত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য দ্রুততার সঙ্গে দরপত্রের প্রক্রিয়াটির নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রয়োজনে ঠিকাদারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে যাতে তারা শিগগিরই ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা করে। তবে এটি তাৎক্ষণিক সমাধান। দীর্ঘমেয়াদে এ সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থাপনাগত জায়গায় কিছু সংস্কার প্রয়োজন। এতে আশা করা যায় সেবার মানও বাড়াবে।
দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে সরকারের উচিত স্বচ্ছ টেন্ডার প্রক্রিয়া চালু করা। পাশাপাশি সরবরাহ ব্যবস্থায় দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে ওষুধ মজুদ ও সরবরাহ ব্যবস্থার নিয়মিত তদারকি আবশ্যক। ওষুধ সরবরাহে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অবহেলা প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া রোগীদের যথাসময়ে ওষুধপ্রাপ্তিতে হাসপাতালগুলোর ফার্মেসি ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে এবং পরিচালন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। প্রতি বছরই কিছু সিজনাল রোগে ভুক্তভোগী হয় মানুষ। সেক্ষেত্রে আগের বছরের সংখ্যা নিরূপণ করে চলমান বছরে কী পরিমাণ ওষুধ ও সেবার প্রয়োজন হতে পারে তার প্রাক্কলন করা জরুরি। সেই প্রাক্কলন মোতাবেক কী পরিমাণ অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ ফার্মেসিতে থাকা প্রয়োজন সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।
তবে ঋতু পরিবর্তনজনিত রোগের সময় সরকারি হাসপাতালগুলোয় ওষুধ সংকটের পাশাপাশি আরেকটি সংকট দেখা দেয়। সেটি হলো শয্যা সংকট। রোগী ভর্তির সংখ্যার তুলনায় শয্যা অপ্রতুল। এক্ষেত্রে অস্থায়ী শয্যা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। হাসপাতালের অন্যান্য ওয়ার্ডে অস্থায়ী শয্যার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে ভালো হয় যদি আক্রান্তের সংখ্যা কমানো যায়। এর জন্য স্থানীয় পর্যায়ে জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। মানুষকে সচেতন করতে হবে যেন শিশুদের ঠাণ্ডাজনিত রোগ থেকে রক্ষায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। এর বাইরে দীর্ঘমেয়াদি একটি সমাধান হতে পারে স্বাস্থ্য বাজেট বৃদ্ধি, যাতে বাজেটের দিক থেকে ওষুধ সরবরাহে সংকট তৈরি না হয়।
সরকারি হাসপাতালে ওষুধ সংকট জনস্বাস্থ্যের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করে। এ সংকট মোকাবেলা করতে হলে সব অংশীজনের সমান দায়িত্বশীল হওয়ার বিকল্প নেই। এবিষয়ে সরকারকে কঠোর নজরদারি দিতে হবে। চিকিৎসা এবং ওষুধ প্রপ্তি নাগরিকের মৌলিক অধিকার।
লেখক : সাংবাদিক।