দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লেনদেনের পরিমাণ। তাৎক্ষণিক টাকা লেনদেন কিংবা পাঠানোর সুবিধার কারণে দেশের ব্যাংকিং সেবায় যা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। প্রান্তিক পর্যায়ে তাৎক্ষণিক আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এখন মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) বা মোবাইল ব্যাংকিং। সাথে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল পরিশোধ, কেনাকাটার বিল পরিশোধ, বেতন-ভাতা বিতরণ ও বিদেশ থেকে টাকা পাঠানোসহ (রেমিট্যান্স) বিভিন্ন সেবা একই মাধ্যমে নাগালে এসেছে গ্রাহকদের। পাশাপাশি অনেক নতুন নতুন সেবা যুক্ত হচ্ছে এ সেবায়। আর এজন্যই দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এমএফএস মাধ্যমটি। নিত্যনতুন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আবির্ভাবে বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা। মানুষ ব্যাংকে গিয়ে চেক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ভোগান্তি এড়াতে কার্ড দিয়ে এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলার সুযোগ পেলেন। এখন সেই প্লাস্টিক ব্যাংকিংকে পিছনে ফেলে অনেক এগিয়ে গেছে মোবাইল ব্যাংকিং। মোবাইল ফোন রিচার্জ, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেবার বিলের পাশাপাশি ঘরে বসে পরিশোধ করা যাচ্ছে ই-কমার্সের মাধ্যমে কেনা পণ্যের দাম। আর এসব সেবার সহজ লভ্যতায় গত এক বছরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, গত অক্টোবর মাসে একক মাস হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে। গত জুনে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল। এটি ছিল একক মাসের হিসাবে সবচেয়ে বেশি। চলতি বছরের অক্টোবর মাসে মোবাইলে আর্থিক লেনদেন বেড়েছে আরও বেশি। এ মাসে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। যা একক মাসের হিসাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন। সূত্র জানায়, গত ২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১১ সালের ৩১ মার্চ বেসরকারি খাতের ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালুর মধ্য দিয়ে দেশে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের যাত্রা শুরু হয়। এর পরপরই ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে বিকাশ। বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার বাজারের সিংহভাগই বিকাশের দখলে।
জানতে চাইলে এমএফএস সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থনীতি আস্তে আস্তে চাঙা হচ্ছে। ফলে মোবাইল ফাইন্যান্সের লেনদেন বাড়ছে। এখন মানুষ কষ্ট করে লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা জমা ও উত্তোলনের চেয়ে সহজে ঘরে বসে মোবাইল ফাইন্যান্সের মাধ্যমে লেনদেন করছে। এর ফলে সামনের দিনগুলোতে এমএফএস সেবার আওতা ও পরিধি বাড়বে। সক্রিয় গ্রাহকসংখ্যা কমার কারণ হিসাবে দেশের সবচেয়ে বড় এমএফএস সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের এ কর্মকর্তা বলেন, একদিকে যেমন গ্রাহক সংখ্যা বাড়ছে অন্যদিকে সক্রিয় গ্রাহকও কিছু কমবে এটা স্বাভাবিক। কারণ তিনমাস ব্যবহার না করলে তিনি নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। সরকারের বিভিন্ন সুবিধাভোগীদের অর্থ সহায়তা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রদান করছে। যাদের মধ্যে অনেকে এখন সক্রিয় নয়। তার মানে তাদের হিসাব বন্ধ হয়েছে তা নয়। যখন লেনদেন চালু করবে তখন আবার সক্রিয় হয়ে যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন হয়েছে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা, ২০১৫ সালে হয়েছে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের চালু থাকা হিসাব ৭৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ বা ৩ কোটি ৭৩ লাখ বেড়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, সরকারি বিভিন্ন দফতরের বিল ও অন্যান্য সেবামূল্যের ফি পরিশোধের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্মকর্তাদের বেতন দিতে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রত্যেকদিন গ্রাহকরা ১ হাজার কোটি টাকার বেশি বিভিন্ন ধরনের বিল পরিশোধ ও একে অন্যদের কাছে পাঠাচ্ছে। এছাড়াও মোবাইল ফোনের টক-টাইম রিচার্জ, ইউটিলিটি বিল, ডিজিটাল সেবার বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে। এসবের পাশাপাশি ই-কমার্সে ব্যবসায়ীদের বিল দেওয়ার মোবাইল অ্যাপস জীবনযাত্রাকে সহজ করেছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, সেবার মান বাড়ানোর পাশাপাশি আন্তঃব্যাংক লেনদেন চালু করার জন্য শিগগিরই একটি নীতিমালা জারি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে একই স্থানে একাধিক কোম্পানির এজেন্ট না থাকলেও চলবে। এভাবে শুরু করা গেলে কোম্পানিগুলোর পরিচালন ব্যয় অনেক কমে যাবে। ভোগান্তিও কমে যাবে। মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদান প্রতিষ্ঠানগুলো উল্লিখিত সেবার পাশাপাশি নতুন নতুন সেবা চালু করছে। এরমধ্যে রাইড শেয়ারিং সেবার বিল, স্কুলের টিউশন ফি, সরকারি উপবৃত্তির অর্থ পরিশোধ করা যাচ্ছে। এসব খাত মোবাইল ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসায় লেনদেন বেড়েছে ২০ শতাংশ।