রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে উদ্যোগ নেওয়া নগর পরিবহন আবারও ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। তাই ঢাকায় যেকোনো রুটে বাস চলতে হলে ঢাকা নগর পরিবহনের আওতায় আসতে হবে। যানজট নিরসনে এবং যাত্রীদের আরামদায়ক পরিবহন সেবা দিতে পুনরায় ঢাকা নগর পরিবহন চালুর পরিকল্পনা করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তথ্যমতে, ঢাকা নগর পরিবহনের আওতায় বাস পরিচালনা করতে বাস কোম্পানিগুলোকে আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে আবেদন করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আগামী জুন মাস থেকে মেট্রো রেলের মতো র্যাপিড পাস দিয়েও ব্যবহার করা যাবে এসব বাস। পর্যায়ক্রমে বসানো হবে ক্যামেরা।
গতকাল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবনের বুড়িগঙ্গা হলে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির ২৯তম সভা শেষে ব্রিফিংয়ে এসব কথা জানান প্রশাসক নজরুল ইসলাম। এ সময় ডিএসসিসি প্রশাসক নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকা পরিবহন ব্যবস্থার সমস্যার তো কোনো শেষ নেই। আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বাস মালিক সমিতি ও পরিবহন শ্রমিক সমিতির প্রতিনিধির সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। যে সমস্যার কথা বলা হয়েছে; সেই সমস্যাগুলো আমরাও স্বীকার করি। কিন্তু আমরা আশা করি, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে সুযোগ আমাদের এসেছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমরা পরস্পর সহযোগিতার মাধ্যমে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারবো। পাশাপাশি ঢাকা শহরের যানজটকে দূর করে মানুষের জন্য আরামদায়ক ট্রান্সপোর্টেশনের ব্যবস্থা যেনো আমরা করতে পারি সেই লক্ষ্যে আমরা আজকের মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করি, অতীতের পরিবেশের চেয়ে একটি সুন্দর পরিবেশে আমরা এখন কাজ করছি, এই পরিবেশ অব্যাহত থাকলে, এই কমিটি যে সিদ্ধান্তগুলো দিয়েছে, সেটি আমরা খুব সহজে বাস্তবায়ন করতে পারবো।
ঢাকা নগর পরিবহনের বাসগুলো আবার কবে চালু হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ৩০ তারিখের মধ্যে কোম্পানিগুলো থেকে আবেদনগুলো নিবো। তারপর আমরা কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে রুট ঠিক করে দিবো এবং কোম্পানির সিস্টেমে গাড়িগুলো পরিচালনা করবো। আগামী ১১ ডিসেম্বর আমাদের আরেকটি মিটিং আছে। মিটিংয়ের আগে কমিটি সুপারিশ করবে। সেই সুপারিশের ভিত্তিতে আমরা মিটিংয়ে সিদ্ধান্তগুলো চূড়ান্ত করে কার্যকরী ব্যবস্থা নেবো। তিনি আরো বলেন, বাসগুলো নগর পরিবহন নামে চলবে, কিন্তু মালিকানায় থাকবে বেসরকারি কোম্পানি। তাদের নির্দিষ্ট রুট থাকবে। আমরা র্যাপিড পাস, অনলাইনে পেমেন্ট সিস্টেমে চলে যাবো। যাতে ড্রাইভার ও হেলপারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা না হয়।
এ ব্যাপারে বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের পরিচালক ধ্রুব আলম বলেন, নগর রুট রেশনালাইজেশনের মতবিনিময় করেছেন। মতবিনিময়ে বাস মালিকদের বক্তব্য শোনা হয়েছে। বাস মালিকেরা অনেক রুট নতুন করে বিন্যাস করতে বলেছেন। এখন এ বিষয়ে আরও আলোচনা করে পরিকল্পনা ঠিক করা হবে। ধ্রুব আলম বলেন, আমরা ৪২টি রুটই ওপেন (খুলে) করে দিচ্ছি। একটি রুটে একটি মাত্র বাস কোম্পানিই গাড়ি চালাতে পারবে। এ ক্ষেত্রে যারা রুট ভায়োলেশন (শৃঙ্খলা ভঙ্গ) করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ডিটিসিএ সূত্র বলছে, ঢাকায় যখন নগর পরিবহন চলাচল শুরু হয় তখন বাসের মোট রুট ছিল ১১০টি। পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২০ টিতে।
বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ১৩০টি রুটে বাস চলাচল করছে। এসব রুট কমিয়ে ৪২টি রুট করবে ডিটিসিএ। ২০১৬ সালের শুরুতে ছয়টি কোম্পানির অধীনে ছয় রঙের বাস নামানোর উদ্যোগ নেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) তৎকালীন মেয়র (প্রয়াত) আনিসুল হক। ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর তার মৃত্যুর পর থেমে যায় প্রকল্প। এরপর ২০২০ সালে বাস রুট রেশনালাইজেশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ৯টি ভিন্ন ভিন্ন রঙের, ২২টি কোম্পানি ও ৪২টি রুটের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে নগর পরিবহন ৬টি (রুট ৩৪ টি) ও শহরতলি পরিবহন ক্লাস্টার ৩টি (রুট ৮ টি)। নগর পরিবহনের বর্তমান ৫৪টি রুটকে সমন্বয় করে ৮টি রুটে পরিণত করা হয়েছে; যেগুলোর রুট নম্বর ২১ থেকে ২৮। আর এটি দেখভাল করছে ডিটিসিএ।
জানা যায়, রাজধানীর নগর পরিবহন বাসকে এযাবৎ যাত্রীবান্ধব ও সুশৃঙ্খল করার যত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার সবই প্রায় ব্যর্থ হয়েছে। রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থায় বাস সব সময়ই যেন এক আক্ষেপের নাম। এমনই একটি ব্যর্থ উদ্যোগ ছিল ঢাকা নগর পরিবহনের বাস চালু। গত ২০২১ সালে যা চালু হয় ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত। পরিকল্পনায় ছিল- তিন বছরের মধ্যে এমন বাস চলবে ঢাকার সব রুটে। তবে বাস্তবতা হলো বিগত সরকারের উদাসীনতা আর বাস মালিক সমিতির অসহযোগিতায় মুখ থুবড়ে পড়ে সেই উদ্যোগ। এ বিষয়ে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আক্তার বলেন, যারা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট অপারেট করে তাদের কাছ থেকে আমরা আবেদন চেয়েছিলাম। আমরা বিপুল পরিমাণে সাড়া পেয়েছি। প্রায় ৮০টি কোম্পানি আবেদন করেছে। আমরা একটি ছোট কমিটি করবো। কি পদ্ধতিতে বাসগুলো চলবে সেটি ঠিক করার জন্য। তিনি আরো বলেন, মূলত আমরা কোম্পানিভিত্তিক বাস পরিচালনা করার কথাই ভাবছি। প্রধানত যে যে রুটে বাস পরিচালনা করছে; তারা যাতে সেই রুটেই বাস চালাতে পারে আমরা সেই দিকটায় জোর দিবো।
এ বিষয়ে গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক বলেন, এই জায়গাগুলোয় রাজনৈতিক দৃঢ় প্রত্যয় লাগবে; যেটা মেয়ররা করতে পারতেন কিন্তু তারা সেদিকে যাননি। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে চার শতাংশ সুদে চার হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট বানিয়ে চলে গিয়েছিলেন। এই প্রজেক্ট সফল হবে না যেনেও তারা এটা করেছিলেন। এ পদ্ধতিতে বাস পরিচালনায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি আলাদা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ শামসুল হক। তিনি বলেন, সঠিক তত্ত্বাবধান না হলে একচেটিয়া সিন্ডিকেট গড়ে উঠতে পারে এই উদ্যোগে।
নগর পরিবহন পরিকল্পনা অনুয়ায়ী জানা যায়, গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে স্টপেজ ছাড়া যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা ও দুই স্টপেজের মধ্যবর্তী স্থানে বাসের দরজা বন্ধ রাখার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মাধ্যমে ১১০ টিরও বেশি বাস স্টপেজ তৈরি করা হয়েছে। প্রয়োজন অনুসারে স্থান চিহ্নিত করে আরও নির্মাণ করা হবে। সচল ও অচল বাস রুটগুলো ২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত হালনাগাদ করা হচ্ছে। এর ওপর ভিত্তি করে ও ডিটিসিএ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত প্রস্তাবের সমন্বয়ে অচল রুট বাতিল ও নতুন রুটের পরিকল্পনা প্রয়োজন বোধে আংশিক পরিবর্তন করে হালনাগাদ করা হচ্ছে।
বাস রুট রেশেনালাইজেশন প্রসঙ্গে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির আহ্বায়ক সাইফুল আলম বলেন, ডিটিসিএ আগে থেকেই এসব নিয়ে অনেক পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু তারা কোনোটিতেই সফল হতে পারেনি। নগর পরিবহন ঢেলে সাজানো উচিত। কিন্তু এটার অনেক সমস্যা আছে।
বেসরকারি মালিকানার গাড়িগুলোতে দায়দেনা আছে। এই গাড়িগুলো সর্বপ্রথম একত্রিত করতে হবে। নইলে এই গাড়িগুলোর দায় কে নেবে। আমরা বলেছিলাম, যে যে রুট দিবে ওই রুটে যেসব গাড়ি আছে সেগুলো একত্রিত করার মতো হলে সেটা করবে। অন্যথায় সরকার এই গাড়িগুলো কিনে নিতে পারে বা রিপ্লেস করতে পারে। এই ব্যবস্থা না করে এলোপাতাড়ি রুট করে দেওয়া হলে আরও যানজট হবে; আরও সমস্যা বাড়তে পারে।