ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলায় গ্রেফতার শিলাস্তি রহমান ও তানভীর ভূঁইয়ার পর আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন আমানুল্যা সাঈদ ওরফে শিমুল ভূইয়া (৫৬)। এ নিয়ে গ্রেফতার তিন আসামিই আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিলেন। জবানবন্দি দেয়া অন্য দুই আসামি হলেন- ফয়সাল আলী সাজী ওরফে তানভীর ভূইয়া (৩০) ও শিলাস্তি রহমান (২২)।
বুধবার দ্বিতীয় দফার রিমান্ড শেষে আসামি আমানুল্যাকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর তিনি দায় স্বীকার করে স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিতে রাজি হলে তা রেকর্ড করার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন তার জবানবন্দি রেকর্ড করছেন। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন বিচারক।
এর আগে গত ৪ জুন জবানবন্দি দেন তানভীর ভূঁইয়া। তার জবানবন্দি সূত্রে জানা যায়, তানভীর ও অন্যান্য আসামিরা পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ভিকটিম আনোয়ারুল আজিম আনারকে প্রলুব্ধ করে কলকাতায় নিয়ে যান। তিনি আনার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীনের পরিকল্পনার প্রধান সমন্বয়ক আমানুল্যা সাঈদ ওরফে শিমুল ভুইয়ার ভাতিজা। তিনি তার চাচা আমানুল্যার পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ৬ মে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতের কলকাতায় যান এবং সেখানে সল্টলেক আর নিউটাউনের মাঝামাঝি ত্রিশিব নামক হোটেলে উঠেন। সেখান থেকে বিভিন্ন সময়ে পরিকল্পনার অংশ হিসাবে আসামি আমানুল্যার সাথে দেখা সাক্ষাত করে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে। এরপর পরিকল্পনা মোতাবেক ভিকটিম আনোয়ারুল আজিম আনারকে প্রলুব্ধ করে কলকাতায় নিয়ে যান তিনি।
এর আগে গত ৩ জুন জবানবন্দি দেন শিলাস্তি রহমান। তার জবানবন্দি থেকে জানা যায়, শিলাস্তি রহমান নিহত আনোয়ারুল আজিম আনার অপহরণের ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীনের কথিত বান্ধবী। আনার হত্যা ও লাশ গুমের সমন্বয়ক আমানুল্যা সাঈদ ওরফে শিমুল ভূইয়ার সাথে গত ৩০ এপ্রিল কলকাতায় যান এবং সেখানে মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীনের ভাড়াকৃত বাসায় উঠেন। ভাড়াকৃত বাসাটি আক্তারুজ্জামান শাহীন ও শিলাস্তি রহমানের নামে চুক্তি ছিলো এবং আনারকে হত্যা ও লাশ গুমের সময় শিলাস্তি রহমান এ বাসাতেই বসবাস করছিলেন। পরবর্তীতে হত্যা ও লাশ গুমের সমন্বয়ক আমানু্ল্যা সাঈদ ওরফে শিমুল ভূইয়ার সাথে গত ১৫ মে বাংলাদেশে চলে আসেন।
শিলাস্তি রহমান ভিকটিমকে হত্যার পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ভারতের কলকাতার নিউটাউন এলাকায় যান এবং ঐ চুক্তিকৃত ভাড়াবাসাতেই উঠেছিলেন মর্মে স্বীকার করেন। জবানবন্দিতে সে মামলার ঘটনার সাথে জড়িত অন্যান্য আসামিদের নাম-ঠিকানা ও পরিচয় প্রকাশ করে এবং মামলার ঘটনা সম্পর্কে ধারাবাহিক বর্ণনা দেয়।
এ মামলায় গত ৩১ মে তিন আসামির আটদিনের প্রথম দফার রিমান্ড শেষ হয়। এদিন তাদের আদালতে হাজির করে মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আরও আটদিনের রিমান্ড আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. শান্ত ইসলাম মল্লিকের আদালত প্রত্যেকের পাঁচদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আসামিরা হলেন- আমানুল্যা সাঈদ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া (৫৬), ফয়সাল আলী সাজী ওরফে তানভীর ভূঁইয়া (৩০) ও শিলাস্তি রহমান (২২)। এর আগে গত ২৪ মে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আসামিদের আটদিনের রিমান্ডে পাঠান ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দিলরুবা আফরোজ তিথি।
এর একদিন আগে ২৩ মে এ তিন আসামিকে অপহরণ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে চুয়াডাঙ্গার দর্শনার গেদে সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান এমপি আনার। ওঠেন পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার মণ্ডলপাড়া লেনে গোপাল বিশ্বাস নামে এক বন্ধুর বাড়িতে। পরদিন চিকিৎসক দেখানোর কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন। এরপর থেকেই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ আনোয়ারুল আজীম।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার পাঁচদিন পর গত ১৮ মে বরাহনগর থানায় আনোয়ারুল আজীম নিখোঁজের বিষয়ে একটি জিডি করেন বন্ধু গোপাল বিশ্বাস। এরপরও খোঁজ মেলে না তিনবারের এই সংসদ সদস্যের। ২২ মে হঠাৎ খবর ছড়ায়, কলকাতার পার্শ্ববর্তী নিউটাউন এলাকায় বহুতল সঞ্জীবা গার্ডেনস নামে একটি আবাসিক ভবনের বিইউ ৫৬ নম্বর রুমে আনোয়ারুল আজীম খুন হয়েছেন। ঘরের ভেতর পাওয়া গেছে রক্তের ছাপ। তবে ঘরে মেলেনি মরদেহ। এ ঘটনায় ২২ মে ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন।
মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, ৯ মে রাত ৮টার দিকে আমার বাবা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের সংসদ সদস্য ভবনের বাসা থেকে গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন। ১১ মে ৪টা ৪৫ মিনিটে বাবার সঙ্গে মোবাইলে ভিডিও কলে কথা বললে বাবার কথাবার্তায় কিছুটা অসংলগ্ন মনে হয়। এরপর বাবার মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন দিলে বন্ধ পাই। ১৩ মে আমার বাবার ভারতীয় নাম্বার থেকে হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ আসে। মেসেজে লেখা ছিল ‘আমি হঠাৎ করে দিল্লি যাচ্ছি, আমার সঙ্গে ভিআইপি আছে। আমাকে ফোন দেওয়ার দরকার নেই। পরে ফোন
দেবো’।
এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, আমরা বিভিন্ন জায়গায় বাবার খোঁজখবর করতে থাকি। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানতে পারি অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে বাবাকে অপহরণ করেছে। বাবাকে সম্ভাব্য সব স্থানে খোঁজাখুজি করেও পাইনি।