শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ব্যাপক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে আগে থেকেই নড়বড়ে আর্থিক খাতে। বিগত বছরগুলোতে হাতছাড়া হওয়া ব্যাংকগুলোর দখল নিতে মরিয়া আগের উদ্যোক্তারা। বর্তমান পরিচালকদের অপসারণে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ব্যাংকে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা বিক্ষোভ করছেন। বিভিন্ন গ্রুপ, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি-কর্তাদের অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া ও দুর্নীতিবাজ অনেক কর্মকর্তাকেও ব্যাংক থেকে বের করে দিয়েছেন ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা। আটকে দেওয়া হচ্ছে স্বার্থসংশ্লিষ্টদের শত শত কোটি টাকার চেক। আবার ব্যাংকের দখল ধরে রাখতে বিক্ষুব্ধদের ওপর গুলি চালানোর ঘটনাও ঘটছে।
এমন পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন সংকটে থাকা দেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে আরও নাজুক হয়ে পড়েছে। নগদ টাকার সংকট দেখা দিয়েছে সর্বত্র। এটিএম বুথের বেশিরভাগই বন্ধ, চেকে ২ লাখ টাকার বেশি উত্তোলনও করা যাচ্ছে না। আস্থাহীনতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকও। তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে নগদ সহায়তাও দিতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বন্ধ হয়ে গেছে আন্তঃব্যাংক লেনদেনও। আবার দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুপস্থিতিতে সৃষ্ট নিরাপত্তাহীনতায় ব্যাংকগুলোর প্রধান কার্যালয় থেকে শাখাগুলোতে টাকা পাঠানো যাচ্ছে না। ফলে দেশে সর্বত্র নগদ টাকার সংকট দেখা দিয়েছে।
জানা যায়, দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অস্থিরতা দেখা দিয়েছে এস আলম নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোতে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, কমার্স ব্যাংকে। এর বাইরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন আইএফআইসি এবং সাবেক ভ‚মিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইউসিবির দখল নিতে বিক্ষোভ, হামলা, পাল্টা হামলার ও গুলি চালানোর মতো ঘটনা ঘটছে। হামলার ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের এসএভিপি ড. শওকত আলী সাংবাদিকদের বলেন, আমরা জানতে পারি, এস আলমের বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যাংকের যারা আছেন, যারা ব্যাংকটিকে লুটপাট করেছেন, তারা একত্রিত হয়ে তাদের লোকদেরই ব্যাংকে বসাবেন। এ তথ্য পেয়ে তারা যাতে ব্যাংকে না ঢুকতে পারেন, সেজন্য আমরা ব্যাংকের সামনে অবস্থান নিই। একপর্যায়ে এস আলমের লোকজন সিটি সেন্টারে অবস্থান নেন। তারা মিছিল নিয়ে প্রধান কার্যালয়ে প্রবেশ করতে চান। তখন ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাদের প্রতিহত করতে গেলে এস আলমের সন্ত্রাসীরা তাদের উদ্দেশ্য করে গুলি চালায়। বৈষম্যবিরোধী ব্যাংকাররা ওই সময় প্রতিরোধ করলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়।
ব্যাংক খাতের সার্বিক নিরাপত্তা বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, যেসব ব্যাংকে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে, সেসব ব্যাংকে হয়তো আগে থেকেই কোনো ঝামেলা বা অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। এসব ব্যাংকে উচ্ছৃঙ্খল কিছু কার্যকলাপ ছিল। ভালো ব্যাংকে কিছু হচ্ছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে। সূত্র জানায়, দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই ইসলামী ব্যাংকে অস্থিরতা বিরাজ করছে। সরকারের পতনের পরদিনই ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ। এর পর থেকে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যাংকে ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দেওয়া হয় বিক্ষোভ থেকে। সেই সময় প্রধান কার্যালয়ে অবস্থিত মুজিব কর্নারও ভাঙচুর করা হয়।
ওই ঘটনার পর ব্যাংকের কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) নেতা আনিসুর রহমান জানান, এস আলম গ্রপের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর থেকে পরীক্ষা ছাড়া অনিয়মের মাধ্যমে যেসব নিয়োগ হয়েছে; সেসব নিয়োগ বাতিল করা হবে। একই সঙ্গে ওই সময়ের পর যাদের চাকরি অবৈধভাবে বাতিল করা হয়েছে, তাদের চাকরি পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এ ছাড়া গত সাত বছরে যারা পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন, তাদের যথাযথভাবে পদোন্নতি দেওয়া হবে। ইসলামী ব্যাংকের পরিস্থিতি নিয়ে এক মতবিনিময় সভায় অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ইসলামী ব্যাংকের দখল নিয়ে সংঘাত ও গোলাগুলিতে যারা জড়িত, তাদের শিগগির আইনের আওতায় আনা হবে। আমি নিজেও একসময় ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম। এসব ধরপাকড় কম করিনি। এ ঘটনার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথা বলা হবে। যারা দোষী, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
অস্থিরতা দেখা দিয়েছে বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকেও। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও তার ছেলেসহ বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিনিধিত্বকারী সব পরিচালকের পদত্যাগ দাবি করেছেন ব্যাংকটির চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহ এ সরোয়ারের সময়ে ‘অন্যায়ভাবে’ যাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, তাদের পুনর্বহালের দাবি তোলা হয়েছে। গতকাল রাজধানীর পুরানা পল্টনে অবস্থিত ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে দুই শতাধিক লোক ‘আইএফআইসি ব্যাংকের চাকরিচ্যুত সকল কর্মকর্তাবৃন্দ’ এই ব্যানারে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় বিক্ষোভকারীরা ৯ দফা দাবি উত্থাপন করেন।
এসব দাবির মধ্যে রয়েছে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরি থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, তাদের অবিলম্বে পুনর্বহাল করা। তবে যারা ইতিমধ্যে চাকরির বয়স অতিক্রম করেছেন, তাদের পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধিসহ পাওনা পরিশোধ করতে হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিল না করা, ঋণের সুদ মওকুফ না করা, দ্রæত খেলাপি ঋণ আদায়, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত করা, ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যকার ভয়ের সংস্কৃতি দূর করা, সাবেক এমডি শাহ আলম সরোয়ার ও তার সহযোগীদের বিচার করা, পদোন্নতি না পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি দেওয়া ইত্যাদি।
অস্ত্রের মহড়া দেখা যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও। অতি সংবেদনশীল এ স্থাপনায় গত বৃহস্পতিবার অস্ত্রসহ প্রবেশ করে ১৫-২০ জন বহিরাগত। এ সময় এক যুবকের কাছ থেকে সেনাবাহিনীর সহায়তায় আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল (অব.) মো. শামিমুর রহমান বলেন, অস্ত্রসহ আটক যুবক বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের কাছে প্রায় দিনই আসত। থানা সচল না থাকায় অস্ত্র জব্দ করে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। থানা সচল হলে জিডি করে অস্ত্র থানায় জমা দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আগে অনেক অনিয়ম হয়েছে; এখন সেগুলোর প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। আগে জোর করে মালিকানা পরিবর্তন করা হয়েছে, লুটতরাজ করা হয়েছে, এসব কারণে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অনেকে চাকরি হারিয়েছে। বিভিন্ন কারণে এসব হচ্ছে। সরকারকে যেটা করতে হবে, দ্রæততার সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আগে দ্রæত ঠিকঠাক করতে হবে। সবার সঙ্গে বসে সুন্দর একটা সমাধান বের করতে হবে। যারা আগের মালিক তাদের মালিকানা ফিরিয়ে দিতে হবে। একটা কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এস আলমকে মালিকানা থেকে বের করে দিতে হবে।