পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার অধিকারকে বুকের রক্ত দিয়ে আপন করে নেয়ার রেকর্ড শুধু বাঙালীর। রফিক, সালাম, বরকত, শফিউরসহ নাম না জানা অসংখ্য শহীদের রক্তস্নাত এই অর্জন বিশ্বে বাঙালীকে অমর করে রেখেছে। যতদিন লাল-সবুজের পতাকা খচিত এই বাংলাদেশ থাকবে, বাঙালী থাকবে, বঙ্গবন্ধু থাকবেন ততদিন পৃথিবীর বুকে বাংলা ভাষা আপন মহিমায় চিরজাগরুক থাকবে। ভাষা আন্দোলন সংঘটিত করার ক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য অবদান রয়েছে। মাতৃভাষাপ্রেমী বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্ব থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন সক্রিয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের একচ্ছত্র অধিপতি হলেন। এ সময় নবগঠিত পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে পূর্ব বাংলার প্রতি তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ভাষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করলে বাঙালীরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে পূর্ব পাকিস্তানের পরবর্তী কর্তব্য নির্ধারণে সমবেত হয়েছিলেন কিছু রাজনৈতিক কর্মী। সেখানে পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। সে প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসে অনন্য একটি ঘটনা। বৈষম্য, বঞ্চনা ও নিপীড়নের যে শাসননীতি পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে দিতে শুরু করে তার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণ এই সময় থেকে সচেতন ও অধিকার আদায়ে আন্দোলনমুখী হতে শুরু করে।
আর ভাষাভিত্তিক এ আন্দোলন হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব মানুষকে নিজের অধিকার আদায়ে যূথবদ্ধ করে তোলে। এই সফল আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হয়। বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এই ভূখণ্ডের অধিকার ও স্বাধিকার আদায়ে প্রতিটি আন্দোলনে তিনি সামনে থেকে দৃঢ়ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অংশগ্রহণ ও অবদান ভাষাসংগ্রামীদের স্মৃতিকথন ও অন্যান্য লেখায় স্পষ্ট করে প্রতিভাত হলেও তথ্যগত অসম্পূর্ণ ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রাম, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আমাদের পথ দেখিয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশ আজও পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির ভাষার অধিকার অর্জনেরও পথিকৃৎ হয়ে আছে। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। বাংলা ভাষায় সংবিধান প্রণীত করেন বঙ্গবন্ধু। এটিই একমাত্র দলিল যা বাংলা ভাষায় প্রণীত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রথম বাংলায় বক্তব্য দিয়ে বিশ্বসভায় বাংলাকে তুলে ধরেন। বাংলা ভাষা আজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। বিংশ শতকের চল্লিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘সভ্যতার সঙ্কট’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আজও আশা করে আছি পরিত্রাণকর্তা আসবে সভ্যতার দৈববাণী নিয়ে, চরম আশ্বাসের কথা শোনাবে পূর্ব দিগন্ত থেকেই। বাঙালীর ভাগ্যাকাশে সেই ত্রাণকর্তা হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সচেতনভাবে বাঙালীর কাছ থেকে ভাষার অধিকার হরণ করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল সংখ্যালঘু জনগণের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে। কিন্তু তাদের সেই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন বাঙালীর ত্রাণকর্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। আজীবন মাতৃভাষাপ্রেমী এই মহান নেতা ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্বে ১৯৪৮ সালে রাজপথে আন্দোলন ও কারাবরণ, পরে আইনসভার সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অতুলনীয় ভূমিকা রাখেন। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি বাংলা ভাষাকে তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর কাছে। এক কথায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় অংশগ্রহণ ইতিহাসের অনন্য দৃষ্টান্ত। এমনকি ১৯৫২ সালের পরও বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে ছেড়ে যাননি। ভাষা আন্দোলনের সফলতার পর্বে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদান, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন, সংসদের দৈনন্দিন কার্যাবলী বাংলায় চালু প্রসঙ্গে তিনি আইনসভায় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বঙ্গবন্ধুর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। সেদিন সব আন্দোলন, মিছিল এবং নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়ার আহ্বান জানান এবং অবিলম্বে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট প্রণীত ২১ দফার প্রথম দফা ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষি, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান সমকালীন রাজনীতি এবং বাংলা ভাষার উন্নয়নে অবদান রাখেন।
এছাড়া ১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু সংসদের দৈনন্দিন কার্যসূচী বাংলা ভাষায় মুদ্রণ করার দাবি জানান। ৭ ফেব্রুয়ারির অধিবেশনে তিনি খসড়া শাসনতন্ত্রের অন্তর্গত জাতীয় ভাষা সংক্রান্ত প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, পূর্ববঙ্গে আমরা সরকারী ভাষা বলতে রাষ্ট্রীয় ভাষা বুঝি না। কাজেই খসড়া শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের ভাষা সম্পর্কে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তা কুমতলবে করা হয়েছে। উল্লেখ্য, পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ৫৬ ভাগ লোকই বাংলা ভাষায় কথা বলে- এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোন ধোঁকাবাজি করা যাবে না। পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবি এই যে, বাংলাও রাষ্ট্রভাষা হোক। ১৬ ফেব্রুয়ারি আইনসভার অধিবেশনেও তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনের প্রথম সরকারী নির্দেশ জারি করেন। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জারিকৃত এক আদেশে বলা হয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজী ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, মাতৃভাষার প্রতি যার ভালবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙালী কর্মচারীরা ইংরেজী ভাষায় নথি লিখবেন সেটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছৃঙ্খলতা চলতে দেয়া যেতে পারে না।
১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা একাডেমিতে একটি সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেন, ভাষা আন্দোলনে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমি ঘোষণা করছি, আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল সরকারী অফিস-আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু হবে। এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষা সৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করব না। কারণ তাহলে সর্বক্ষেত্রে কোনদিনই বাংলা চালু করা সম্ভবপর হবে না। এ অবস্থায় হয়ত কিছু কিছু ভুল হবে। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না, এভাবেই অগ্রসর হতে হবে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। এটাই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের মূল নায়ক ও স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভাষা আন্দোলনেরই সুদূরপ্রসারী ফলশ্রুতি। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার এই ধারাবাহিক আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছে আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা। এই মহান আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহান স্থপতির ভূমিকা পালন করে আমাদের একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছেন। বাংলাদেশ নামক এ ভূখণ্ডের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই স্বীকার করতে হবে।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক