ই-পেপার শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪
শিরোনাম: প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত কাল        মোবাইল ইন্টারনেট চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে আগামীকাল : পলক       মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ও ফেসবুক চালুর বিষয়ে যা জানা গেলো       নেপালে বিমান বিধ্বস্ত, নিহত ১৮       আগামী ৩-৪ দিনের মধ্যে সব নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী       খুলেছে অফিস-আদালত, গণপরিবহন সংকটে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি        বান্দরবানে কেএনএফের দুই সদস্য নিহত      




একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধ ও স্বপ্নের বাংলাদেশ
রায়হান আহমেদ তপাদার
Published : Friday, 22 March, 2024 at 2:44 PM
বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের গৌরবজনক ঘটনা বা অধ্যায় হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে বাঙালি জাতির শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো একটি জাতির স্বপ্নের নাম। যে স্বপ্ন জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। যে চেতনা বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল একটি গণতান্ত্রিক ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায়।পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে বাংলার মানুষ স্বপ্ন দেখে স্বাধীনভাবে চলার, স্বাধীনতা ও মুক্তির। কিন্তু তাদের স্বপ্ন অচিরেই ভঙ্গ হয়ে যাই। পশ্চিমারা শাসন শোষণ শুরু করে বাঙালিদের উপর। বাঙালি ব্রিটিশদের থেকে মুক্তি পেয়ে পড়ে যায় আরেক ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের কাছে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক শাসন-শোষণে নিপীড়ত হয় বাঙালিরা। ১৯৪৭ সাল থেকে তারা নির্যাতন করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। এ সময়কাল বাঙালি জাতির শোষিত হওয়ার ইতিহাস, পাকিস্তানিদের বর্বরতার ইতিহাস। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন,'২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস, এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।' বাঙালি জাতির সবচেয়ে সর্বাপেক্ষা গৌরবের ইতিহাস তার স্বাধীনতার ইতিহাস। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল এক অধ্যায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস বর্বরতার মুখে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু হয় বাঙালি মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। যা দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভের পর হানাদার বাহিনীর আত্নসমর্পনের পর পরিসমাপ্তি ঘটে। দীর্ঘ ৯ মাস সংগ্রামের পূর্ণতা আসে ৯৩ হাজার সৈন্য নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করলে। এই ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙালি পায় নিজস্ব লাল সবুজের মানচিত্র।পৃথিবীর মানচিত্রে যুক্ত হয় স্বাধীন সার্বভৌম এক দেশ, যার নাম বাংলাদেশ।

৫৩ বছর আগে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী থেকে মুক্তি পেয়েছিল বাঙালি জাতি। ৩০ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে ২ লক্ষ মা বোনদের ত্যাগ তিতিক্ষার, কোটি বাঙালির আত্মনিয়োগের মাধ্যমে আমরা এই স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছি। বাংলাদেশ নামে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পেয়েছি। আন্তর্জাতিক মানচিত্রে নাম লিখিয়েছি আমাদের দেশের নাম। স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে বাঙালিদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিও বাঙালি জাতিকে নিয়ে দেখেছেন অনেক স্বপ্ন।তিনি এই জাতির স্বপ্ন পূরণ করেছেন অনেক। যেই বাঙালিরা পশ্চিমা পাকিস্তানিদের দ্বারা শোষিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত। সেই জাতি আজ পৃথিবীর বুকে গৌরবের সাথে বলতে পারে, আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। এদেশকে আমরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে স্বাধীন করেছি। যদি আমরা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগের ইতিহাস দেখি তাহলে বাঙালিরা স্বাধীন হতে চেয়েছিল অনেক আগে থেকে। একটি স্বাধীন বাংলাদেশ বাঙালিদের অনেক দিনের দাবি ছিল। তা লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-ভারত বিভক্তির পরে বাঙালি জাতি আলাদা একটি স্বাধীন দেশের দাবি করে। কিন্তু পশ্চিমা দেশ পাকিস্তান বাঙালিদের ঔপনিবেশ করে রাখার জন্য তারা বাঙালিদের দাবি উপেক্ষা করে। পরবর্তীতে তারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে। কারণ একটি জাতিকে ধ্বংস করতে হলে তাদের মাতৃভাষাকে কেড়ে নিতে হয়। তাই তারা বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু তাতে তারা সফল হলো না। বাঙালি বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মাতৃভাষা বাংলাকে কেড়ে নিতে দেয়নি। ১৯৪৮-১৯৫২ পর্যন্ত বাঙালিরা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন ও সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের পর পশ্চিমা শাসকরা চিন্তায় পড়ে যায়। তারা বিভিন্ন চক্রান্ত শুরু করে যুক্তফ্রন্টের নামে। ১৯৫৫ সালে রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করে। এরপর ১৯৫৮ সালে সামরিক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক জান্তা আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত শোষণ করে বাঙালিদের। ১৯৬৯ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা দাবি করে। তারা গণআন্দোলন শুরু করে। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করার পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা ছাড়তে দেরী করে। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ৪ দফা দাবি পেশ করে। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা বুঝিয়ে না দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে বাঙালিদের উপর অতর্কিত হামলা চালায় তার জান্তা সরকার। যা অপারেশন সার্চলাইট নাম দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। বাঙালিরা জাতি, বর্ণ, নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে জয়লাভ করে। স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পায় বাঙালিরা। যারা জাতির স্বাধীনতা বয়ে আনার জন্য সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছিল এবং যারা বুকের তাজা প্রাণ উৎসর্গ করেছিল, তাদের ত্যাগের স্মরণে এ দিনটি উদযাপন করে থাকে বাঙালি জাতি। সবাই স্মৃতিসৌধ এ গিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করছে। নেলসন ম্যান্ডেলা বলেন, 'স্বাধীনতা দীর্ঘজীবি হোক। মানুষের সবচেয়ে বড় এই কৃতিত্ব কেউ যেন কখন ও ভুলে না যায়।' এই প্রতিজ্ঞা থাকুক সকল বাঙালিদের। অপারেশন সার্চলাইট বিশ্বের ইতিহাসে এক নির্মমতার স্বাক্ষর। সেদিন রাতে বাংলার ঘুমন্ত অসহায় মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা৷ অস্ত্র, ট্যাংক, কামানসহ অত্যাধুনিক সামরিক যন্ত্র নিয়ে বাঙালি নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছিল তারা।

বাংলার সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামল মাটিতে বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। নদীর জলরাশি রক্তে লাল হয়ে গেছে৷ অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে ধ্বংসপুরি করতে চেয়েছে এই বাংলাকে। এ অন্যায়, বর্বরতা বাংলার মানুষ সহ্য করেনি। বাঙালিরা থেমে থাকে না, লড়াই করতে জানে। নিজের রক্ত দিয়ে স্বাধীন করতে জানে। যার যেটা আছে সেটা নিয়ে যুদ্ধে চলে গিয়েছে বীর বাঙালিরা। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার আগে প্রথম প্রহরে বাঙালিদের স্বাধীনতার ঘোষণা করে যান৷ তার স্বাক্ষরিত ঘোষণা বার্তাটি তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয়। এরপর চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নামে প্রচারিত করা হয় স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি। বাঙালিদের কাছে যার যেটা ছিল তা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর৷ 

পরিশেষে দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে এই বিজয় ছিনিয়ে আনে। লাল সবুজের স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পায় বাঙালিরা। সমাজ জীবনের সব ক্ষেত্রে সংস্কৃতির চর্চার অভাব, অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মের নামে হিংসা, নারী নির্যাতন এ রকম নেতিবাচক বিষয়গুলো আমাদেরকে পিছিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। বর্তমান প্রজন্ম পাকিস্তানি দুঃশাসন বা পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লড়াই দেখেনি। শুধু শুনেছে বা পড়েছে। তাতে মহান স্বাধীনতা দিবস বর্তমান প্রজন্মের কাছে কতটা স্পষ্ট তা পরিষ্কার নয়; তাই এখানে পরিবারের সিনিয়র সদস্যদের কাজ করতে হবে। আমাদের নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত করতে হবে। বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার ও নিরলস প্রচেষ্টায় ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের জীবনকে নতুন স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে গেছে এবং আমরা নতুন এক মাত্রায় উঠে এসেছি।

বাঙালির ইতিহাস মানেই শোষণ আর অধিকার থেকে বঞ্চনার ইতিহাস। আজকের তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য দরকার মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তাদের সামনে উপস্থাপন। সঠিক তথ্যটি তাদের সামনে তুলে ধরা। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে একটি জাতিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যত ধরনের ব্যবস্থা নেয়া দরকার সব ধরনের ব্যবস্থাই নিয়েছিল পাকিস্তানিরা। এ কারণেই তারা দেশের শ্রমজীবী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের হত্যা করে। যারা বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করতে চাচ্ছিল বাঙালি জাতি কীভাবে তাদের পরাজিত করেছিল তার সঠিক ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা সবারই দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমাদের দেশ আধুনিক যন্ত্র ও প্রযুক্তির ব্যবহারে এগিয়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেট ব্যবহার করে শিক্ষা, তথ্য আদান-প্রদান, ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থিক লেনদেন বাড়ছে। লাখ লাখ মানুষ লেখাপড়া, জীবিকা, চিকিৎসাসহ উন্নত সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। কিন্তু তার পাশাপাশি ধর্মবিশ্বাস, গুজব, অনলাইনে হয়রানি সমান তালে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এগুলো নিয়ে আমাদের আরও কাজ করতে হবে। দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ করার জন্য পরিবার, সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হবে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির কাছে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা এবং যতদিন বাঙালি জাতি থাকবে ততদিন এই মুক্তিযুদ্ধই থাকবে শ্রেষ্ঠ গৌরবের অধ্যায় হিসেবে, অবিস্মরণীয় এক গৌরবগাথা হিসেবে।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক







সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক : কে.এম. বেলায়েত হোসেন
৪-ডি, মেহেরবা প্লাজা, ৩৩ তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত এবং মনিরামপুর প্রিন্টিং প্রেস ৭৬/এ নয়াপল্টন, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স: ৪১০৫২২৪৫, ৪১০৫২২৪৬, ০১৭৭৫-৩৭১১৬৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন: ৪১০৫২২৫৮
ই-মেইল : [email protected], [email protected], [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
পিএবিএক্স: ৪১০৫২২৪৫, ৪১০৫২২৪৬, ০১৭৭৫-৩৭১১৬৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন: ৪১০৫২২৫৮
ই-মেইল : [email protected], [email protected], [email protected]