দশম বিপিএলের দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার ম্যাচে মুখোমুখি হচ্ছে রংপুর রাইডার্স ও ফরচুন বরিশাল, দলীয় এই লড়াইয়ের আবহ সঙ্গী হয়ে বাজছে দেশের ক্রিকেটের বড় দুই তারকা সাকিব ও তামিমের ব্যক্তিগত দ্বৈরথ। ফরচুন বরিশালের প্রধান কোচ মিজানুর রহমানের ভাবনা কেবল নিজের দল নিয়ে। রংপুরের প্রধান কোচ সোহেল ইসলামের ভাবনায়ও একই। দুই দলের কোচ স্বাভাবিকভাবেই এড়িয়ে যেতে চাইছেন লড়াইয়ের ভেতরে সাকিব-তামিম লড়াইকে। জিতলে ফাইনাল, হারলে বাদ- এমন সমীকরণে অন্য কিছু ভাবার জায়গাও নেই তাদের দিক থেকে। তবে বাস্তবতা হলো, বিপিএলের দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার ম্যাচের আবহ সঙ্গীত হয়ে বাজছে সাকিব-তামিম লড়াই।
এলিমিনেটরে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে নামার সুযোগ পেয়েছে বরিশাল। প্রথম কোয়ালিফায়ারে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের কাছে হেরে ফাইনালের ওঠার দ্বিতীয় সুযোগ হিসেবে ম্যাচটি পেয়েছে রংপুর। মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শুরু হবে খেলা। অলিখিত সেমিফাইনাল হওয়ায় এমনিতেই এই ম্যাচের উন্মাদনা তুঙ্গে। তবে এতে বাড়তি রঙ ছড়িয়েছে সাকিব-তামিমের ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েনও। দেশের শীর্ষ দুই ক্রিকেটারের মুখোমুখি লড়াই আগেও দেখেছে বিপিএল। তখনও রোমাঞ্চ ছড়িয়েছে মাঠের লড়াই। তবে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে মাঠের বাইরের নানা ঘটনায়। গত বছরের বিশ্বকাপের আগে একরকম উন্মুক্তই হয়ে গেছে দুজনের বিরোধ। যদিও আরও আগে থেকেই অবনতির দিকে ছিল দুজনের সম্পর্ক। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানও যা বলেছেন প্রকাশ্যে। গত ওয়ানডে বিশ্বকাপের দলে তামিমের না থাকা ও পরে টি- স্পোর্টস চ্যানেলে সাকিবের বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারের পর দুজনের দ্বন্দ্বের ব্যাপারটি প্রকট আকার ধারণ করে আরও। এরপর দুই ভাগ হয়ে গেছে বাংলাদেশের সমর্থকগোষ্ঠিও। সামাজিক মাধ্যম তো বটেই, মাঠেও বিব্রতকর পরিস্থিতির সামনে পড়ছেন সাকিব-তামিমরা। কখনও সাকিবকে দেখে শুরু হয় ভুয়া ভুয়া স্লোগান। আবার কখনও সীমানার কাছে যেতেই দুয়োধ্বনি শোনেন তামিম। খুব আদর্শ বা কাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এসব নয় অবশ্যই। তবে এটিই এখনকার বাস্তবতা। দুজনের মুখোমুখি লড়াইয়ে এখন বাড়তি উত্তাপ।
যা হয়তো কখনও কখনও ছুঁয়ে যায় সাকিব-তামিমকেও। লিগপর্বের ম্যাচে সাকিব আক্রমণে আসতেই প্রথম বলে আউট হন তামিম। পরে দ্বিতীয় ইনিংসে সাকিব আউট হওয়ার পর সীমানার কাছে দাঁড়িয়ে সাকিবের উদযাপন অনুকরণ করেন তামিম। তার মুখাবয়বে দেখা যায় বিদ্রুপের ছাপও। সেই ম্যাচের পর আবার মুখোমুখি হচ্ছেন দুজন। এবার মঞ্চ আরও বড়। দেশের ক্রিকেটে আলোচিত দুই তারকার একজনই কেবল খেলতে পারবেন এবারের ফাইনালে।
সম্পর্কের ঝাঁঝ ছাড়াও ক্রিকেটীয় দিক থেকেও এই ম্যাচে দুজনের লড়াইটা হতে পারে জমজমাট। টুর্নামেন্টের শুরুটা খুব ভালো ছিল না দুজনের কারও। তবে ক্রমেই তারা ফিরেছেন আপন চেহারায়। ১৩ ইনিংসে ৪৪৩ রান করেছেন তামিম, এখনও পর্যন্ত যা আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ১৬১ স্ট্রাইক রেটে ২৫৪ রান আর ওভারপ্রতি মাত্র ৬.১৫ রান দিয়ে ১৭ উইকেটের যুগলবন্দিতে টুর্নামেন্ট সেরা হওয়ার দাবিদার সাকিব। দুজনের ব্যক্তিগত পারফম্যান্সের বড় ভূমিকা থাকতে পারে এই কোয়ালিফায়ার ম্যাচের ফলাফলেও। বড় ম্যাচ হওয়ায় এমনিতেই দর্শক আগ্রহ বেশি হওয়ার কথা। সাম্প্রতিক সময়ে দুই তারকা ক্রিকেটারের বিপরীতমুখী অবস্থানে সেটি যেন বেড়ে গেছে বহুগুণে। অনলাইন টিকেট শেষ হয়ে গেছে নিমেষে। টিকেটপ্রত্যাশীদের ভিড়ও ছিলো।
আগের দিন ম্যাচ খেলার পর গতকাল মঙ্গলবার বিশ্রামেই কাটিয়েছেন দুই দলের মূল ক্রিকেটাররা। মিরপুরের একাডেমি মাঠে ঐচ্ছিক অনুশীলনে ঘাম ঝরিয়েছেন কয়েকজন। অনুশীলনের ফাঁকে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে রংপুর কোচ সোহেল বললেন, সাকিব-তামিমের প্রসঙ্গের গভীরে যেতে চান না তিনি। ব্যক্তিগত ইস্যু নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। এটা নিয়ে একদমই চিন্তা করি না। আমার দল নিয়ে চিন্তা করি। দলের মধ্যে সেও (সাকিব) একটা অংশ। প্রতিপক্ষ দলে যে (তামিম) আছে, সেও তাদের দলের অংশ। দলের পারফরম্যান্সে ক্রিকেটার কীভাবে প্রভাব রাখতে পারবে, সেটা নিয়েই চিন্তা করি। ব্যক্তিগত ইস্যু নিয়ে চিন্তা করার কোনো সুযোগ নেই এখানে।
একই কথার প্রতিধ্বনি ছিল বরিশালের কোচ মিজানুরের কণ্ঠে। আমরা নিজেদের খেলাটা উপভোগের চেষ্টা করি। ম্যাচের মধ্যে তামিম-সাকিবের জিনিসটা আমাদের মাথায় আসে না। আমি চাই, আমরা যে দলে কাজ করি... তামিম সেরা ক্রিকেট খেলুক, আমার দল জিতুক। এই জিনিসটা উপভোগ করি। মাঠের খেলাটা উপভোগ করি।
দুজন অবশ্যই বাংলাদেশের দুই সেরা ক্রিকেটার। দুজন দুই দলে খেলে। দুজনই চাইবে নিজের দলকে জেতাতে। এই টুর্নামেন্টে দুজনই ভালো ক্রিকেট খেলছে। তাই যে ভালো খেলবে, তার দল জিতবে।
প্রথম পর্বে দুই দলের লড়াইয়ে একটি করে জয় বরিশাল ও রংপুরের। টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় দিন রংপুরকে ৫ উইকেটে হারিয়ে যাত্রা শুরু করে বরিশাল। পরে ফিরতি ম্যাচে রোমাঞ্চ ছড়িয়ে ১ উইকেটের জয়ে মুখোমুখি লড়াইয়ে সমতা ফেরায় রংপুর।
তবে সবশেষ দুই ম্যাচে আবার জয় পায়নি শীর্ষে থেকে লিগ পর্ব শেষ করা রংপুর। দুই ম্যাচই তারা হেরেছে কুমিল্লার কাছে। ঠিক বিপরীত অবস্থায় বরিশাল। কুমিল্লাকে হারিয়ে প্লে-অফের টিকেট নিশ্চিত করেছে তামিমের দল। এরপর চট্টগ্রামকে হারিয়ে তারা পেয়েছে দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারের টিকেট।
টানা দুই জয়ের পর এবার রংপুরের বিপক্ষে ম্যাচে আরেকটি ভালো দিনের আশায় বরিশাল কোচ। আমরা একটা ভালো ছন্দে, ভালো অবস্থায় এসেছি। শুরুর দিকে যে অবস্থা ছিল, এখন ভালো অবস্থানে আছি। সবাই ভালো খেলছে। যারাই দল বানায়, জিততে চায়। আমরাও জিততে চাই। অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। দুই দল প্রায় একই রকম শক্তির। যেহেতু এটা সেমি-ফাইনালের মতোই, যারা ভালো খেলবে কালকে, তারাই জিতবে। ছোট-বড় দল নেই কোনো। পরপর দুই পরাজয়ে বরিশালের তুলনায় কিছুটা হলেও চাপে থাকার কথা রংপুরের। বিশেষ করে প্রথম কোয়ালিফায়ার ম্যাচে ১৮৫ রানের পুঁজি নিয়েও কুমিল্লাকে আটকাতে পারেনি তারা। লিটন কুমার দাস, তাওহিদ হৃদয়ের ব্যাটিংয়ের জবাব খুঁজে পাননি সাকিব, হাসান মাহমুদ, জিমি নিশাম, মোহাম্মদ নাবিরা। সবশেষ ম্যাচে কিছু ঘাটতির কথা মানছেন দলটি প্রধান কোচও। তা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় সোহেল ইসলামের।
ক্রিকেট খেলায় চাপ থাকবে না, তা তো হতে পারে না। বিপিএলের মতো টুর্নামেন্টে প্লে-অফ পর্বের খেলা চলছে, চাপ থাকবেই। আর এটা জয় করেই খেলতে হবে। সবশেষ ম্যাচে আমরা ভালো স্কোর করেছি তবে বোলিংয়ে কিছু জায়গায় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারিনি।
ওই ম্যাচ নিয়ে আর ভাবছি না। সামনের ম্যাচ নিয়ে চিন্তা করছি। সবশেষ ম্যাচ থেকে তো শিখেছি, আমাদের কোথায় উন্নতি করতে হবে। সেগুলো নিয়েই ছেলেদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। আমরা শক্তভাবে ঘুরে দাঁড়াতে চাই। এখন তো আর কোনো বিকল্প নেই। ভুল শুধরে বরিশালকে আরও একবার হারাতে পারলে প্রায় সাত বছর পর ফাইনালের টিকেট পাবে রংপুর। সবশেষ ২০১৭ সালের আসরে ফাইনাল খেলে তারা। ঢাকা ডায়নামাইটসকে হারিয়ে এখন পর্যন্ত নিজেদের একমাত্র শিরোপাও সেবার জেতে ফ্র্যাঞ্চাইজিটি। ছন্দ রেখে রংপুরের বাধা উতরে গেলে এক আসর পর আবারও শিরোপা নির্ধারণী মঞ্চে নামতে পারবে বরিশাল। ২০২২ সালে ফাইনালে উঠেছিল দলটি। সেবার কুমিল্লার কাছে স্রেফ ১ রানে হেরে শেষ হয় তাদের শিরোপার স্বপ্ন। ফাইনালে উঠতে পারলে এবারও কুমিল্লার সামনেই পড়বে তারা।