গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার বড় প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগে। রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে বিনিয়োগ ও শিল্প খাতের কার্যক্রমে ধীরগতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অর্থায়ন সংকোচনসহ বিভিন্ন কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমেছে। বাংলাদেশে ২০২৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি মাঝারি হলে মুদ্রাস্ফীতি দ্বিগুণ অঙ্কে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগের প্রভাব আগামী অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে।
গত জুলাই ও আগস্টে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাণিজ্য বিঘ্নিত হওয়ায় চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পাঁচ দশমিক এক শতাংশে নামিয়ে এনেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। তথ্যমতে, ম্যানিলাভিত্তিক বহুপাক্ষিক ঋণদাতা সংস্থাটি এর আগে পূর্বাভাসে বলেছিল, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে পণ্য ও সেবার সার্বিক উৎপাদন ছয় দশমিক ছয় শতাংশ হবে। এডিবি বলছে, সাম্প্রতিক বন্যা বিবেচনায় নিয়ে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমানো হয়েছে। রাজস্ব ও আর্থিক নীতিগুলো কঠোর থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। ক্রয় ও বিনিয়োগ আরও কমাবে। নেতিবাচক ঝুঁঁকি থাকায় সামষ্টিক অর্থনীতির পূর্বাভাস অত্যন্ত অনিশ্চিত। প্রাথমিকভাবে এই ঝুঁঁকিগুলো চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ভঙ্গুর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও আর্থিক খাতে দুর্বলতা থেকে সৃষ্টি হয়েছে।
জানা যায়, আন্দোলন ও সরকার পতনের আগে ও পরের ধ্বংসযজ্ঞ, ক্ষমতার পালাবদলের পর পুলিশহীন দিনগুলোতে নিরাপত্তাহীনতায় ব্যবসা-বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ায় অর্থবছরের শুরুটা দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেই ভালো যায়নি। এতে আমদানি-রপ্তানি থেকে শুরু করে উৎপাদন, পণ্য সরবরাহ, প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ পদে পদে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ ও রাজস্ব আহরণে ভাটা দেখা গিয়েছে; আরও ক্ষত বাড়ার শঙ্কা দেখা দিচ্ছে। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জিং সময়ে নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। গত অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত তারল্য সংকোচনের মুখে পড়ে এবং ঋণ প্রবৃদ্ধি ধীর হয়ে যায়। খেলাপি ঋণ উচ্চ পর্যায়ে থাকে এবং সংজ্ঞা ও রিপোর্টিং মানের কারণে প্রকৃত অবস্থা আড়ালে থাকে। ব্যাংকিং খাতের ভঙ্গুরতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমার অন্যতম কারণ।
বিদেশি মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের রপ্তানিতে ধাক্কা লেগেছে সবার আগে। কারখানায় কাজ বন্ধ থাকার পাশাপাশি ইন্টারনেট শাটডাউন ও সহিংসতার ঘটনা ক্রেতাদের কাছে নেতিবাচক বার্তা দিয়েছে। পণ্য রপ্তানিতে বাড়তি ঝামেলা ও ব্যয়ের চাপ সামলাতে হয়েছে উদ্যোক্তাদের। রপ্তানি আয় ১২ থেকে ১৫ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকরক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালক শোভন ইসলাম। স্প্যারো অ্যাপারেলস লিমিটেডের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন বলেন, এমনিতেই জুলাইয়ে রপ্তানি কম থাকে। তবে এ বছর কী হয়েছে তো জানেনই। বাংলাদেশ গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই মাসে রপ্তানি থেকে আয় করে ৪ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে পোশাক রপ্তানি থেকে আসে ৩ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। যা মোট রপ্তানি আয়ের ৮৬ দশমিক ০৫ শতাংশ। এ খাতের ওপর ভিত্তি করেই দেশের সামগ্রিক রপ্তানি আয় বাড়ে; তবে সংঘাত আর নৈরাজ্যের পর কারফিউয়ের মধ্যে দেশের ব্যাংকিং চ্যানেল এবং ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকায় সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের সবচেয়ে বড় এ খাতেই।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাইতে পোশাক খাতে রপ্তানি হয় ৩ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ দশমিক ২৪ শতাংশ কম। পরিসংখ্যান বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, অ্যাসাইকুডার তথ্যে বকেয়াসহ দেখায়। অনেক টাকা পরিশোধ হয়নি কিন্তু যেহেতু মাল খালাসের মাধ্যমে সে পরিমাণ রাজস্ব আসার কথা, সেটিও থাকে। ধারণা করা হচ্ছে, গত কয়েক মাস ধরে অ্যাকচ্যুয়াল রাজস্ব আহরণ অনেক কমছে। মূসক ও আয়করেও একই রকম প্রভাব দেখা দেওয়ার আশঙ্কা এ কর্মকর্তার। তবে বাণিজ্যে অচলতার ফলে রাজস্ব ঘাটতির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি এনবিআরের নতুন চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খানও। তিনি বলেন, ইকোনমি আবার যখন ভালো হবে এর ইফেক্ট আমরা ভালোভাবে পাব। নৈরাজ্যের ধাক্কা কাটিয়ে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কীভাবে অর্জন হবে এমন প্রশ্নে আব্দুর রহমান বলেন, লক্ষ্যমাত্রা তো অর্জনের চেষ্টা করাই লাগবে। এই জন্য আমাদের অফিসারদের বলব ডিউ ডেলিজেন্স, প্লানিং এবং প্রোপার এক্সেকিউশন করতে। হার্ড ওয়ার্ক করতে হবে। ইন্টেন্স হার্ড ওয়ার্ক করতে হবে তাদেরকে। হার্ড ওয়ার্ক করলে রেজাল্ট আসবেই।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩ দশমিক ২ থেকে ৫ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে। এর মধ্যবর্তী পয়েন্ট ৪ শতাংশ। উল্লেখযোগ্য অনিশ্চয়তার কারণে প্রবৃদ্ধির অনুমানের মধ্যে এত পার্থক্য রাখা হয়েছে। অন্যান্য কারণের পাশাপাশি সাম্প্রতিক বন্যাও প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করবে। আর আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে সাড়ে ৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির বিষয়ে বিশ্বব্যাংক বলেছে, খাদ্যের উচ্চ মূল্য এবং সরবরাহজনিত সমস্যার কারণে চলতি অর্থবছরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বজায় থাকবে। তবে তা গত অর্থবছরের ৯ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশে নামতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আগামীতে স্থানীয় ও বৈশ্বিক কিছু ঝুঁঁকি চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক। প্রথমত, পুলিশ বাহিনী পুরোপুরি কার্যক্রমে ফিরে না আসা পর্যন্ত নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের সময় নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে ভিন্নমত ভবিষ্যতে রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি করতে পারে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পাশাপাশি অন্য ঝুঁঁকির মধ্যে রয়েছে– কিছু ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা, দুর্বল করপোরেট শাসন, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও বাণিজ্য অংশীদার দেশে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া।
ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যা, ডলারের দাম বৃদ্ধি ও সংকট এবং সুদের হার বৃদ্ধির কারণে আগে থেকেই বেসরকারি বিনিয়োগে ধীরগতি চলছিল। এর সঙ্গে যোগ হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। গত জুলাইতে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশে অস্থিরতা থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে বড় প্রভাব পড়ে। আন্দোলনের মধ্যে সহিংস পরিস্থিতিতে বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট। কয়েক দফায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। ফলে ব্যাংকসহ অফিস-আদালতের কার্যক্রম থেমে যায়। পরে ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মুখে হাসিনা সরকারের পতন হয়। গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলেও বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে কারখানাগুলোতে বিক্ষোভ আর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সেই সঙ্গে পুলিশি তৎপরতা না থাকায় নিরাপত্তা সংকটে অনেক কারখানাই বেশ কিছু দিন বন্ধ ছিল। এসব কারণে আমদানি-রপ্তানি ও বিনিয়োগে প্রভাব পড়েছে।
এছাড়া বেশ আগে থেকেই ডলার সংকট ও দাম বৃদ্ধি, সুদের হার বৃদ্ধি, গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যাসহ অনুকূল পরিবেশের অভাবে বিনিয়োগে আগ্রহ কম দেখিয়ে আসছেন ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (গবেষণা) মো. এজাজুল ইসলাম বলেন, বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কম হবে। এমনিতেই জুলাইয়ে কম থাকে। তবে আগের অর্থবছরের গত কয়েক মাস ধরে পলিটিক্যাল আনরেস্ট ছিল না; এবার যেহেতু ছিল। তাই কম হওয়ার কথা।
তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে উত্তাল অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে স্থবিরতার মধ্যে মাসটিতে বিদেশি ঋণ ছাড়েও বড় ধাক্কা এসেছে। উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রাখতে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে যে পরিমাণ বিদেশি অর্থ এসেছে; তার চেয়ে বেশি পরিমাণে ঋণ যাচ্ছে শোধ করতেই। গণ আন্দোলনে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড কিছুটা ব্যহত হয়েছে। সরবরাহ শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল। তবে এখনও অর্থবছরের সাড়ে ১০ মাস আছে। দ্রুত সব ঠিক হবে না; তবে আরেকটু সময় নিয়ে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।