আমাদের সবার মনে আছে, মহামারি করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের দফায় দফায় নানা বিধি-নিষেধে কর্মহীন হয়ে পড়ে শ্রমজীবী মানুষ। এর প্রভাবে মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের পরিবারগুলো চরম আর্থিক সংকটে পড়ে। ইতোমধ্যে হু হু করে বেড়ে চলেছে ভোগ্য পণ্যসহ বিভিন্ন জিনিসিপত্রের দাম। এমন দামের কারণে একেবারই বেসামাল সাধারণ মানুষ। তাদের ব্যয় বাড়লেও, বাড়ছে না আয়। ফলে সংসার চলাতে হাঁসফাঁস উঠেছে তাদের। বাংলাদেশে গত এক বছরে চাল ও আটার মতো পণ্যের দাম না বাড়লেও শুধু অক্টোবরেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে সর্বোচ্চ হয়েছে। কৃষি ও বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বেশিরভাগ সময় সিন্ডিকেটের দিকে আঙুল তোলা হলেও এর পেছনে আরও বেশ কিছু কারণ রয়েছে। কারণ অনেক সময় উৎপাদন বেশি হলেও বাজারে ঠিকমতো সরবরাহ হয় না। আবার উৎপাদন ও আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ার প্রভাবও পড়েছে অনেক পণ্যের দামে। সরকারি যেসব তথ্য দেয়া হয়, সেখানেও প্রকৃত অবস্থার সাথে তারতম্য থাকে। যদিও বিশ্লেষকদের অনেকে বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিরপেছনে শুধু সিন্ডিকেটকে দায়ী করতে চান না, তবে এ নিয়ে বাংলাদেশে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির পেছনে সিন্ডিকেট বা ব্যবসায়ীদের কারসাজিকে বিভিন্ন সময় দায়ী করা হয়েছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ও সরকারের কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে। গত কয়েক মাস ধরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে চরম বিপাকে পড়েছেন দেশের সাধারণ মানুষ। শ্রমজীবীদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। চাল, ডাল, চিনি, তেলসহ প্রায় প্রতিটি নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম এখন আকাশচুম্বী। সাধ্যের বাইরে মুরগি, গরু ও খাসির গোশত। পেঁয়াজ, আলু, ডিম, কাঁচা মরিচ-সবকিছুর দামই ঊর্ধ্বমুখী। খাদ্য মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। জীবনধারণের জন্য খাদ্য অত্যাবশ্যক, আবার সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ পুষ্টিমানসম্পন্ন ও সুষম খাবার গ্রহণ করা প্রয়োজন।
একজন মানুষ যখন তাঁর প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ করতে পারেন না, তখন তিনি কোনো কাজই ঠিকঠাক করতে পারেন না। নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েই চলছে। শত চেষ্টা করেও বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কিন্ত কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, এমন প্রশ্ন প্রতিটি সাধারণ মানুষের কাছে নিয়মিত ঘুরপাক খাচ্ছে। সুজা কোথায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এখন একটি আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা শুনলেও মানুষ ততটা ভয় পান না, যতটা এখন দ্রব্যমূল্য নিয়ে পাচ্ছেন। একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের কথাই ধরি, যাঁর ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা, তাহলে প্রশ্ন জাগে, তিনি কীভাবে এই দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে মানিয়ে জীবনধারণ করছেন? এই আট হাজার টাকা মজুরির মধ্যে দুই হাজার টাকা বা এর বেশি ব্যয় হয় ঘরভাড়া বাবদ। বাকি টাকা দিয়ে সন্তান-পরিবারের খাবার খরচ, মা-বাবা থাকলে তাঁদের কাছে টাকা পাঠাতে হয় আর অসুখবিসুখ তো রয়েছেই দরিদ্র মানুষের নিত্যসঙ্গী! এই অল্প মজুরি দিয়ে ঠিকমতো ভাত-ডালই যাঁদের কপালে জুটে না, তাঁদের আবার আমরা পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার কথা বলি! পুষ্টিকর খাবার সেটা তো রীতিমতো সোনার হরিণ এসব দরিদ্র মানুষের কাছে। এই পুষ্টিহীনতা নিয়ে আমাদের দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ তাদের কর্মক্ষমতা অথবা কর্মদক্ষতা স্বাভাবিকভাবেই কম থাকে। এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, উন্নয়নের জোয়ার বইছে চারদিকে। এই উন্নয়ন দিয়ে কী হবে, যদি মানুষ দুবেলা দুমুঠো খেতে না পারেন, তবে এমন উন্নয়নের দিয়ে কি হবে। এই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে জন সাধারণের মনে। কিন্তু যে দেশের মানুষ মৌলিক অধিকার পূরণ করতে হিমশিম খান, সেখানে উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাই এ ব্যাপারে সরকারের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত। এবং দ্রব্যমূল্য কীভাবে হ্রাস করা যায়, সেদিকে নজর দিয়ে মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।
বর্তমান অবস্থা দীর্ঘ সময় ধরে বিরাজমান থাকলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে আরও বেশি নাভিশ্বাস উঠবে। অভিযোগ রয়েছে, সিন্ডিকেট করে বাজারে পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এর অবসান হওয়া জরুরি। বাজারের অস্থিরতা দূর করতে হলে অবশ্যই অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দমন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিত্যপণ্যের বাজারে কেউ যেন কারসাজি না করে, সেদিকে নজর দিতে হবে। খাদ্য মন্ত্রণালয়কে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। যাঁরা অনিয়ম করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের লাগাম টেনে ধরতে সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এটাই সবার প্রত্যশা। অতীত তথ্য ঘাটলে দেখতে পাওয়া যায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত নাগরিক রাষ্ট্রীয় সম্পদের চুলচেরা ভাগ পায়। অপরদিকে যে জনতার দুর্বার শ্রমে রাষ্ট্রীয় কোষাগার পূর্ণ হয়, সেই জনতা সেই কোষাগার থেকে কোনো বিনিময় পায় না। আয়ের সীমাহীন বৈষম্য, ধনী-গরিবের আকাশচুম্বী ব্যবধান, সুযোগের ব্যাপক প্রায় তারতম্য, দুর্নীতির উল্লম্ফন ধারাবাহিকতা, নির্মম দলীয়করণ ও শাসনতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় একটি বড় মাপের বণ্টন সংকটের উদ্ভব ঘটিয়েছে। এসব উপাদানের সগৌরব উপস্থিতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মৌলনীতিসমূহকে চ্যালেঞ্জ করছে প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা যায় অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সামরিক শাসন দীর্ঘদিন বলবৎ থাকায় নাগরিকবৃন্দ নিয়মতান্ত্রিক শাসন ও অনিয়মতান্ত্রিক শাসন সম্বন্ধে ধারণার অধিকারী হয় না। স্বাধীনতা অব্যবহিতকাল ১৯৭৫ সাল থেকেই বাংলাদেশে অনিয়মতান্ত্রিক শাসন জারি হয় এবং এর ভয়ংকর প্রভাব বলয় তৈরি হয় যার কারণে ১৯৯০ পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় থাকলেও শাসনতান্ত্রিক বিন্যাসটি জনমুখী করা সম্ভব হয়নি।
বাস্তবিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের বাস্তবতায় প্রশাসনিক জটিলতাসহ আরও নানা কারণে সরকার যথেষ্ট মাত্রায় জনগণের কাছে পৌঁছতে পারে না। অর্থাৎ সরকার ও জনগণের মাঝে কার্যকর ও অর্থবহ সংযোগ প্রতিষ্ঠা পায় না। সরকারের সকল উন্নয়ন উদ্যোগ, নীতি এবং এসব বাস্তবায়নে জন-উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়। এই অবস্থাকেই বলা হয় জনগণের মাঝে সরকারের অনুপ্রবেশ প্রায় নেই। জনগণের সঙ্গে সরকারের অনুপ্রবেশ নেই বিধায় জন-অভিপ্রায় সরকার সঠিকভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হয় না। মধ্যবিত্তদের অবস্থা আরো বেশি কঠিন ও দুঃসহ হয়ে উঠেছে। আমাদের সমাজে যারা শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিনসহ সম্মানজনক একটা পেশায় আছেন, তারা পুরো মাস মিলে বেতন পায় ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা অথবা তার চেয়ে কম। যেখানে বর্তমানে একটা পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজন ২০ হাজার টাকা বা আরো বেশি। সেখানে এরকম পেশায় যারা জড়িত আছে, তাদের বেতন প্রয়োজনের অর্ধেকও পোষায় না। তারা সম্মানের ভয়ে না পারে কারো কাছে চাইতে, না পারে প্রয়োজন মেটাতে।তারা এক দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। আমাদের বর্তমান সমাজের জন্য দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি একটি অন্যতম বড় সমস্যা। আমরা সবাই এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণগুলো নিয়ে কথা বললেও এর সমাধান নিয়ে কয়জনই বা বলতে পারি? সঠিকভাবে জানাও নেই এর সমাধান কোথায়। এমনভাবে চলতে থাকলে মানুষের জীবনমান যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা অনুমেয়। বিগত তিন বছর ধরে সাধারণ মানুষ নানা অভাব-অনটনের মধ্যে জীবনযাপন করছে। এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, তারা খাদ্যাভাবে পড়েছে। স্বাচ্ছন্দ্য জীবন থেকে কষ্টকর জীবনে নেমে গেছে। অনেক পরিবার আগে যেখানে সপ্তাহে এক-দুই দিন মাছ-গোশত খেত, এখন তারা তা বাদ দিয়েছে। এমনকি খরচ কমিয়েও কুলিয়ে উঠতে পারছে না। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সর্বত্র পড়ছে।
নিম্ন আয়ের মানুষ নিত্যপণ্য কেনার ক্ষমতা হারিয়ে অল্প খেয়ে অথবা না খেয়ে নিজের সঙ্গে প্রবঞ্চনা করে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ, দেশের সব দামি খাদ্যপণ্যই যেন বিত্তবানদের ভোগের জন্য উধাও হয়ে বড়-ছোট সব ধরনের হিমঘরে ঢুকে পড়ে। বাজারের কৃত্রিম সংকট বিত্তশালীদের রসনাপূজার জন্য সৃষ্ট এক আজব আজাব বা গজব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে! দ্রব্যমূল্য সন্ত্রাসের এই আজব আজাবের শিকার দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের কোটি কোটি মানুষ! এর দায়ভার কে নেবে? এই পরিবেশে তাদের পক্ষে কথা বলারও কেউ নেই। অজানা কারণে প্রচারমাধ্যমে তাদের কথা তেমনভাবে ফুটে ওঠে না। তার ওপর কর্তৃপক্ষের মুখ থেকে এমন বক্তব্য শুধু হাস্যকরই নয়, বড়ই নিষ্ঠুর ও মর্মান্তিক! ভোগ কমে গেলে উৎপাদনও কমে যায়। সাধারণত চাহিদার সঙ্গে উৎপাদনের সমন্বয় করে পণ্য উৎপাদিত হয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে অর্থনীতিসহ মানুষের জীবন যাপনের অবনমন ঘটে। ইতোমধ্যে অনেক উৎপাদক উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। খরচ কমাতে নীরবে কর্মী ছাঁটাই করছে। বেতন বৃদ্ধি দূরে থাক, উল্টো কমিয়ে দিচ্ছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। কর্মজীবীদের এ অবস্থা হলে, কর্মহারাদের কী অবস্থা, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। সাধারণ মানুষের মধ্যে সঞ্চয় করার প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ব্যাংকিং ও সঞ্চয়পত্র খাত চরম আমানত সংকটে ভুগছে। যেসব সাধারণ মানুষ সঞ্চয় করেছিল, তারা জীবনযাপনের খরচ চালাতে সঞ্চয় ভেঙে এবং ব্যাংকে জমানো টাকা তুলে নিঃশেষ হয়ে গেছে। তার সাথে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বিপাকে পড়েছে শিক্ষার্থীরাও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ ক্রমবর্ধমান চাপ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোধ করা প্রয়োজন।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক