মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলার অত্যন্ত মহব্বতের সৃষ্টি মানুষ। আর তাই তো তিনি মানব সৃষ্টির ব্যাপারে ফেরেশতাদের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করেছেন এবং মানুষকে এই জমিনে তার প্রতিনিধি বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
আল কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلاَئِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الأَرْضِ خَلِيفَةً قَالُواْ أَتَجْعَلُ فِيهَا مَن يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاء وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَا لاَ تَعْلَمُونَ
অর্থ: ‘আর তোমার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি, তখন তারা বলল, তুমি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবে যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা প্রতিনিয়ত তোমার গুণকীর্তন করছি এবং তোমার পবিত্র সত্তাকে স্মরণ করছি। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে আমি জানি, যা তোমরা জানো না’। (সূরা: বাকারা, আয়াত: ৩০)।
এই মহব্বত আর ভালোবাসার কারণেই আল্লাহ মানুষকে দান করেছেন তার সৃষ্টিকুলের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর আকৃতি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতর অবয়বে’। (সূরা: ত্বিন, আয়াত: ৪)
শুধু তাই নয়, আল্লাহর সুস্পষ্ট বাণী হচ্ছে, এই বিশ্বজগতের সবকিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন কেবল মানুষেরই জন্য। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য জমিনের সবকিছু’। (সূরা: বাকারা, আয়াত: ২৯)
আল্লাহ যেমন মায়া-মুহব্বত করে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তেমন মায়া ও ভালোবাসা দিয়ে তিনি মানুষ জাতির সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। একজন মানুষের জীবন, সম্পদ, মানসম্মান আল্লাহর কাছে এত দামি যে, কোরআন ও হাদিসে এসব বিষয়ের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর সব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
আল কোরআনে আল্লাহ একজন মানুষ হত্যা করাকে গোটা মানব-জাতিকে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
কাউকে অবৈধভাবে হত্যা করা কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তাআলা হত্যাকারীকে জাহান্নামি ঘোষণা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোনো মুমিনকে হত্যা করে তার শাস্তি জাহান্নাম। যাতে সে দীর্ঘকাল থাকবে, তার ওপর আল্লাহর ক্রোধ ও অভিসম্পাত। আল্লাহ তার জন্য মহাশাস্তি নির্দিষ্ট করে রেখেছেন’। (সূরা: নিসা, আয়াত: ৯৩)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘আর যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো উপাস্যকে ডাকে না, যথার্থ কারণ ছাড়া কোনো মানুষকে হত্যা করে না এবং তারা ব্যভিচার করে না। আর যে এগুলো করবে সে শাস্তির মুখোমুখী হবে। কেয়ামতের দিন তার শাস্তি দ্বিগুন করা হবে। আর সে সেখানে লাঞ্ছিত হয়ে চিরকাল বাস করবে। তবে তারা নয়, যারা তাওবা করবে, ঈমান আনবে আর সৎকাজ করবে। আল্লাহ এদের পাপগুলোকে নেকিতে পরিবর্তন করে দিবেন; আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু’। (সূরা: ফুরকান, আয়াত: ৬৮-৭০)
হত্যার ভয়াবহতার কারণে আল্লাহ তাআলা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির হত্যাকারীকে সব মানুষের হত্যাকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এ কারণেই আমি বনি ইসরাইলের জন্য বিধান দিয়েছিলাম, যে ব্যক্তি মানুষ হত্যা কিংবা জমিনে ত্রাস সৃষ্টির কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করবে সে যেন গোটা মানবজাতিকেই হত্যা করল; আর যে কোনো মানুষের প্রাণ বাঁচালো, সে যেন গোটা মানবজাতিকেই প্রাণে বাঁচালো। তাদের কাছে আমার রাসূলগণ সুস্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে এসেছিল, এরপরও তাদের অধিকাংশই পৃথিবীতে বাড়াবাড়ি করেছিল’। (সূরা: মায়িদা, আয়াত: ৩২)
কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম হত্যাকান্ডের বিচার হবে: আল্লাহর হকের মধ্যে সর্বপ্রথম সালাত এবং বান্দার হকের মধ্য হতে সর্বপ্রথম হত্যা ও রক্তপাতের বিচার হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম হত্যাকান্ডের বিচার করা হবে’। (বুখারি, আসসাহিহ: ৬৫৩৩; মুসলিম, আসসাহিহ: ১৬৭৮)
হত্যাকারীর ক্ষমা পাওয়ার আশা খুবই ক্ষীণ: আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) বলেন, ‘যেসব বিষয়ে কেউ নিজেকে জড়িয়ে ফেলার পরে তার ধ্বংস থেকে নিজেকে রক্ষা করার উপায় থাকে না, সেগুলোর একটি হচ্ছে, অন্যায়ভাবে রক্ত প্রবাহিত করা (অর্থাৎ অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা)’। (বুখারি, আসসাহিহ: ৬৮৬৩)
আবু সাইদ খুদরি ও আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আসমান-জমিনের সমস্ত অধিবাসীরা একত্রে মিলিত হয়েও যদি একজন মুমিনকে হত্যা করার কাজে অংশগ্রহণ করে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাদের সকলকে উপুর করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন’। (তিরমিযি, আসসুনান: ১৩৯৮)
মুয়াবিয়া (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি গুনাহ আশা করা যায় আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করে দেবেন। তবে দু’টি গুনাহ আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করবেন না। প্রথমটি হচ্ছে, কোনো মানুষ কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা, অপরটি হলো ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করা’। (নাসায়ি, আসসুনান: ৩৯৮৪)
হত্যা করা কুফুরির অন্তর্ভুক্ত: কোনো মুসলিম-মুওয়াহহিদকে হত্যা করা কুফরি। কারণ মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অত্যধিক সম্মানিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসিকি এবং তাকে হত্যা করা কুফুরি’। (বুখারি, আসসাহিহ : ৬০৪৪)
এছাড়াও বিদায় হজের ভাষণে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আমার পরে তোমরা একে অপরকে হত্যা করে কাফির হয়ে যেও না’। (বুখারি, আসসাহিহ: ১২১)
মুমিন ব্যক্তিকে হত্যা করা সম্পর্কে কঠোর সতর্কবাণী: আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর নিকট পৃথিবী ধ্বংস হওয়াটা অধিকতর সহজ ব্যাপার একজন মুসলিম ব্যক্তি খুন হওয়ার চেয়ে’। (তিরমিযি, আসসুনান: ১৩৯৫)
নিহত ব্যক্তি হত্যাকারীকে সঙ্গে নিয়ে কিয়ামতের মাঠে উপস্থিত হবে: ইবনু আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন হত্যাকারী তার মাথার সঙ্গে নিহত ব্যক্তির মাথা লটকানো অবস্থায় উপস্থিত হবে। নিহত ব্যক্তি বলবে, হে রব! তাকে জিজ্ঞেস করুন, সে কেন আমাকে হত্যা করেছে?’ (ইবনু মাজাহ, আসসুনান: ২৬২১)
হত্যাকাণ্ডে সহযোগীও হত্যাকারী: মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যার ফলে কেয়ামত দিবসে তারা বহন করবে নিজেদের পাপের বোঝা মাত্রায়, আর তাদেরও পাপের বোঝা যাদেরকে তারা গুমরাহ করেছে, নিজেদের অজ্ঞতার কারণে। হায়! তারা যা বহন করবে তা কতই না নিকৃষ্ট’। (সূরা: নাহল, আয়াত: ২৫)
নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘পৃথিবীতে যত অন্যায় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবে, তার পাপের একটা ভাগ আদম আলাইহিস সালামের প্রথম পুত্রের ওপরও বর্তাবে। কারণ সে-ই প্রথমে হত্যার রীতি চালু করে’। (বুখারি, আসসাহিহ : ৭৩২১)
ইয়া আল্লাহ! অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা হতে ও কাউকে হত্যায় উদ্বুদ্ধ করা বা সহযোগিতা করা হতে আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমিন।