*নতুন করে আর অনার্স কোর্স চালুর সুযোগ থাকছে না
দীর্ঘদিন পর ভাগ্য খুলছে দেশের বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স কলেজ শিক্ষকদের। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সুপারিশে এসব কলেজে কর্মরত প্রায় ৩৫০০ জন শিক্ষককে এমপিওভুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে, নতুন করে দেশে আর কোনো অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করা হবে না। জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে নির্দেশনা আকারে জানিয়ে দেওয়া হবে।
আর দেশের উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের ‘জ্যেষ্ঠ প্রভাষক’ পদ বাতিল করে পূর্বের ‘সহকারী অধ্যাপক’ পদ ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। এর বাইরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন যেসব বেসরকারি কলেজে বিএড কোর্স চালু করে সনদ দেওয়া হয়েছে, এসব সনদ যাচাই ও পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল বুধবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল ও কলেজ) জনবলকাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০২১ সংশোধন সংক্রান্ত সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এদিন দুপুর আড়াইটায় শুরু হওয়া ওই সভায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের সভাপতিত্ব করেন। তবে সভায় দেশের এমপিওভুক্ত কলেজে স্নাতক (পাস) কোর্স পর্যায়ে অর্থ্যাৎ ডিগ্রি কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত ৩য় শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করা নিয়ে ফলপ্রসু কোনো আলোচনা হয়নি। আর সারাদেশে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন ও এমপিওভুক্তির শর্ত নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
বিষয়টি নিশ্চিত করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আজাদ খান ভোরের ডাককে বলেন, মাউশির মতামতের আলোকে সভায় দেশের অনার্স-মাস্টার্স কলেজের ৩৫০০ শিক্ষকের এমপিওভুক্তি ও উচ্চ মাধ্যমিক কলেজগুলোতে সহকারী অধ্যাপকের পদ পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে, দেশের নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন ও এমপিওভুক্তির শর্ত নিয়ে আলোচনা করার কথা থাকলেও সময় স্বল্পতার কারণে তা হয়নি। এর বাইরে ডিগ্রি কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত ৩য় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি নিয়ে ফলপ্রসু কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। পরবর্তী সভায় এটি আবার উত্থাপন করা হবে।
অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির যৌক্তিকতা
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো মাউশির দেওয়া মতামত অনুযায়ী, শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রণীত সর্বশেষ জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০২১ অনুসারে প্রতিটি বিষয়ে উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি পর্যায়ে মোট ২ জন শিক্ষক এমপিওভুক্তির সুযোগ পান। এই নীতিমালার বাইরে কোনো শিক্ষকের এমপিওভুক্তির সুযোগ নেই। ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৯৩-৯৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু হয়। এই কোর্সগুলোর জন্য অনার্সের প্রতি বিষয়ে ৭ জন এবং মাস্টার্সের (প্রিলি ও শেষপর্ব) জন্য ৫ জন, অর্থাৎ মোট ১২ জন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। এই শিক্ষকদের বেতন-ভাতা সাধারণত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি থেকে প্রদান করা হয়, যা শিক্ষকদের মতে অপর্যাপ্ত।
প্রতিবেদনে মাউশি বলছে, ইতিমধ্যে ২০১৮ বিধি অনুযায়ী দেশের ৩৩৪টি কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে। এই জাতীয়করণকৃত কলেজগুলোর উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক (ডিগ্রি) পর্যায়ের শিক্ষক ছাড়াও অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষকরা জাতীয়করণের আওতাভুক্ত হয়েছেন এবং বর্তমানে তারা সরকারি বিধি মোতাবেক পূর্ণাঙ্গ বেতন-ভাতাদি পাচ্ছেন। কিন্তু যেসব অনার্স-মাস্টার্স ও মাদ্রাসার ফাজিল-কামিল পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়নি, যেসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকরা সরকার থেকে কোনো বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। এই পরিস্থিতিতে জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা সংশোধন করে বাদপড়া বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স কলেজ শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সিদ্ধান্ত নিলে এ খাতের শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের আর্থিক বঞ্চনার অবসান ঘটাবে বলে মাউশি তাদের মতামতে উল্লেখ করে।
মাউশি সূত্র জানায়, দেশের অনার্স-মাস্টার্স কলেজের ৩৫০০ শিক্ষককে এমপিও দিলে সরকারের অতিরিক্ত ১শ’ ১২ কোটি টাকা এবং মাদ্রাসার ফাজিল-কামিল পর্যায়ে ২২ কোটি টাকা খরচ হবে।
’সহকারী অধ্যাপক’ পদ ফিরছে, ‘জ্যেষ্ঠ প্রভাষক’ পদ বাতিল
মন্ত্রণালয়ে পাঠানো মাউশির প্রস্তাবনা অনুযায়ী, বেসরকারি উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ শিক্ষকদের পদবি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জটিলতা তৈরি হয়েছে। বুধবারের সভায় শিক্ষাখাতে বিদ্যমান বৈষম্য নিরসনে ‘জ্যেষ্ঠ প্রভাষক’ পদটি বাতিল করে পূর্বের ‘সহকারী অধ্যাপক’ পদ ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
মাউশির প্রস্তাবনা অনুযায়ী, ১৯৯৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এমপিও নীতিমালায় উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা প্রভাষক থেকে সরাসরি সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতেন। কিন্তু, ২০২১ সালের নীতিমালায় পদোন্নতির ক্ষেত্রে নতুন করে ‘জ্যেষ্ঠ প্রভাষক’ পদ সৃষ্টি করা হয়। এই পরিবর্তনের ফলে শিক্ষকদের পদমর্যাদা হ্রাস পায় এবং নানা ধরনের বৈষম্য দেখা দেয়, যা শিক্ষক মহলে ব্যাপক অসন্তোষের জন্ম দেয়।
মাউশি বলছে, এই পরিবর্তনের কারণে ‘জ্যেষ্ঠ প্রভাষকরা’ দেশের বেসরকারি স্নাতক কলেজের উপাধ্যক্ষ পদে আবেদনের যোগ্য হলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী তাদের সেই সুযোগ নেই। ফলে, অনেক যোগ্য শিক্ষক উচ্চ পদে আবেদন থেকে বঞ্চিচ হচ্ছেন। আর একই প্রতিষ্ঠানে একই বেতন কাঠামোয় ভিন্ন পদবির শিক্ষক থাকায় (যেমন: পূর্বে সহকারী অধ্যাপক এবং বর্তমানের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক) একটি অভ্যন্তরীণ বিভাজন তৈরি হয়েছে, যা কর্মপরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এর ফলে ভবিষ্যতে উচ্চ মাধ্যমিক কলেজগুলো স্নাতক পর্যায়ে উন্নীত হলে অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞ শিক্ষকরা উচ্চতর পদমর্যাদা লাভ করবেন, যা বর্তমান জ্যেষ্ঠ প্রভাষকদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করবে। মাউশি আরও জানায়, একই সঙ্গে সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে ‘জ্যেষ্ঠ প্রভাষক’ নামে কোনো পদ না থাকায় বেসরকারি শিক্ষকরা সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছেন।
মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আজাদ খান বলেন, ’সহকারী অধ্যাপক’ পদ ফিরছে, ‘জ্যেষ্ঠ প্রভাষক’ উভয় পদের বেতন স্কেল একই (গ্রেড ০৬), তাই ‘সহকারী অধ্যাপক’ পদ পুনর্বহালে সরকারের কোনো অতিরিক্ত আর্থিক ব্যয় হবে না। বেসরকারি উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য ও অসন্তোষ দূর করতে সরকার এই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মাউশির কর্মকর্তা বলছেন, ‘জ্যেষ্ঠ প্রভাষক’ পদ শিক্ষকদের জন্য বৈষম্যমূলক ও সম্মানহানিকর। ‘সহকারী অধ্যাপক’ পদ পুনর্বহাল হলে শিক্ষকদের পেশাগত উন্নতি ও সম্মান নিশ্চিত হবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইতিবাচক পরিবেশ বজায় থাকবে।
সভাশেষে মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপসচিব (মাধ্যমিক) সাইয়েদ এ. জেড. মোরশেদ আলী ভোরের ডাককে বলেন, সভায় বেসরকারি শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের আর্থিক ও পদমর্যাদা সংক্রান্ত বঞ্চনা নিয়ে দুই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সকল কিছু আর্থিক বিধিবিধান ও প্রশাসনিক নিয়ম মেনে এ বিষয়টি বাস্তবায়ন করবে মাউশি।