প্রশাসন ক্যাডারের বৈষম্যমূলক আচরণ, ডিজিটাল নজরদারি এবং একতরফা শাস্তির প্রতিবাদে ফুঁসছে দেশের ২৫টি সিভিল সার্ভিস ক্যাডার। যার মধ্যে শিক্ষা ক্যাডার অন্যতম। অভিযোগ উঠেছে, প্রশাসন ক্যাডার নির্বিচারে অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলা করছে। অথচ নিজ ক্যাডারের মধ্যে মারামারি ও শোডাউন করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
প্রশাসন ক্যাডারের এরকম অন্তত ২৩জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিপরীতে শিক্ষাসহ ২৫ ক্যাডারের ১২জন কর্মকর্তাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে; যা অনভিপ্রেত ও অনাকাক্সিক্ষত। এ ধরনের আচরণ আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের আন্দোলন দমনের কৌশল হিসেবে মনে করছেন ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তারা।
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক মো. শওকত হোসেন মোল্যা বলেন, স¤প্রতি প্রশাসন ক্যাডার এসোসিয়েশন ঢাকায় সমাবেশ করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে আলটিমেটাম দেয় এবং সে সময়ে ও পরবর্তী তারা অন্য ক্যাডারের সদস্যদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কটূক্তি করেন। এর পূর্বে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ঘেরাও করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন।
তার প্রেক্ষিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিষদের অন্তর্ভুক্ত ২৫টি ক্যাডারের সদস্যদের সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য শুরু হয়। এরই প্রেক্ষিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়াধীন দপ্তর ও সংস্থায় কর্মরত আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের অন্তর্ভুক্ত বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় মত প্রকাশের জন্য ঢালাওভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে জানিয়ে শওকত মোল্যা বলেন, এর মধ্যে শিক্ষা ক্যাডারের ৭জনকে বরখাস্ত করা হয়। সবগুলো বরখাস্তের আদেশ ছিল ত্রæটিপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, কোনো কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়া সামান্য অজুহাতে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত অনভিপ্রেত ও অনাকাক্সিক্ষত।
শিক্ষকদের ফেসবুক ব্যবহারে কঠোর নির্দেশনা
এদিকে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিবের নির্দেশনায় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ফেসবুক ব্যবহারে কঠোর নজরদারির কথা জানিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। গত ২৯ জুন মাউশি থেকে দেশের সব সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ও সংশ্লিষ্টদের কাছে এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে। গতকাল সোমবার চিঠিটি মাউশির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের অনুশাসন’ না মানলে তা চাকরিবিধি লঙ্ঘন ও অসদাচরণের পর্যায়ভুক্ত অপরাধ হবে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারের সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা, সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা-২০১৯ অনুসরণ না করা সরকারি চাকরিবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা ২০১৮ অনুযায়ী অসদাচরণের পর্যায়ভুক্ত অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন এই নির্দেশনা, একদিকে ডিজিটাল নজরদারির বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে প্রশাসন ক্যাডারের পক্ষপাতমূলক আচরণ, শিক্ষা ক্যাডারসহ অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে আরও বেশি ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।
শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের ক্ষোভ
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনায় শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের অভিযোগ, কোনো প্রকার কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই ইতিমধ্যে ৯ জন শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাকে অনৈতিকভাবে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তারা বলছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী ফরেনসিক রিপোর্ট ছাড়া এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অন্যায়। এই বিষয়ে তারা প্রধান উপদেষ্টা ও শিক্ষা উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের অবস্থান
২৫টি ক্যাডারের সমন্বিত জোট আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ প্রশাসন ক্যাডারের পক্ষপাতমূলক আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। তাদের দাবি, প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সরকারি বিধি-বিধান বহির্ভূত কার্যকলাপের পরও কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হলেও অন্যান্য ক্যাডারের সদস্যদের তুচ্ছ কারণে বরখাস্ত করা হচ্ছে। স¤প্রতি এই বৈষম্যের প্রতিবাদে সারা দেশে বিভিন্ন দপ্তরে সফলভাবে কলম বিরতি কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। পরিষদ আরও জানিয়েছে, প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরে মারামারি, মিছিল এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে আল্টিমেটাম দিলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অথচ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখির কারণে ২৫টি ক্যাডারের ১২ জন সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল।
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের আরেক সমন্বয়ক ড. মফিজুর রহমান বলেন, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা মৌলিক অধিকার ও চাকরিবিধির পরিপন্থি। যাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তারা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তা। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে এভাবে বরখাস্ত করায় পরিষদ সদস্যরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, এভাবে সাময়িক বরখাস্ত অব্যাহত থাকলে সিভিল সার্ভিসে চরম অসন্তোষ দেখা দেবে, যা সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে পারে। এ অবস্থায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে জারি করা সাময়িক বরখাস্তের আদেশগুলো প্রত্যাহার করে অভিযোগ থেকে অব্যাহতিদানের অনুরোধ জানাচ্ছি।