লন্ডনে ড. মুহুম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্য ১৩ জুন অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে থাকা সংশয় অনেকটা কেটে গিয়েছিল। তবে বৈঠকের দুই সপ্তাহ পেরোনোর আগেই আবারো সে সংশয়-সন্দেহের দানা বাঁধছে। খোদ বিএনপির নেতারা ভোট নিয়ে শঙ্কা ও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি, সিপিবি, বাসদ, গণ অধিকার পরিষদ, এবি পার্টিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল সংখ্যানুপাতিক বা পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনের দাবি জোরালোভাবে সামনে আনায় বিএনপি বিষয়টি সন্দেহের চোখে দেখছে, তারা বিষয়টি নির্বাচন বিলম্বিত বা বানচালের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে।
জানা গেছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল সংখ্যানুপাতিক বা পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু সে দাবি তেমন জোরালো ছিল না। শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জাতীয় মহাসমাবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে দাবি জানায় দলটি। সমাবেশে অংশ নিয়ে জামায়ত, এনসিপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারাও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের জন্য জোরালো দাবি তোলে।
সমাবেশে মূল বক্তব্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি জানান। তিনি বলেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার দাবি করে তিনি বলেন, যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তাদের তত আসন থাকতে হবে। এটি জনগণের, জেনজি প্রজন্মের এবং সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের যৌক্তিক দাবি। প্রয়োজনে গণভোটের মাধ্যমে জনগণের রায় নিতে হবে।
তার এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, একটি গোষ্ঠী নির্বাচনকে পিছিয়ে দিয়ে জাতির সর্বনাশ করার ষড়যন্ত্র করছে। তিনি বলেন, একেকজন একেকটা দাবি তুলে নির্বাচনকে পিছিয়ে এ জাতির সর্বনাশ করতে চাচ্ছে। তিনি ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ রেজাউল করীমকে উদ্দেশ্য করে বলেন, যখন বিএনপি-জামায়াতের ওপরে স্টিমরোলার চালানো হচ্ছিল, তখন ওই দলটি এবং তার নেতা দূরে থেকে বাহবা দিয়েছেন।
ইনডাইরেক্টলি হাসিনাকে সমর্থন দিয়েছেন। কালো নির্বাচন, রাতের নির্বাচন, দিনের নির্বাচন; তিনবার নির্বাচন হয়েছে, উনারা কোনো প্রতিবাদ করেন নাই। এখন লম্বা কথা বলতেছেন, আগে দিতে হবে স্থানীয় নির্বাচন, এরপর দিতে হবে পিআর সিস্টেম (আনুপাতিক পদ্ধতি)। যত দিন এগুলো না হবে, তত দিন এ দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। পিআর পদ্ধতি কই থেকে আসে প্রশ্ন করে মির্জা আব্বাস বলেন, দেশটাকে সুন্দর করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে কিছু করেন না, শুধু আপনার কথামতোই হতে হবে, স্থানীয় সরকার আগে হতে হবে, আবার পিআর ভোট করতে হবে। কেন ভাই? কই থেকে আবিষ্কার করেন এগুলা? কে দেয় বুদ্ধি আপনাদের? এসব কুপরামর্শ নিয়ে, এই দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করার জন্য একদল লোক আজ মাঠে নেমেছে। এছাড়া বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, যারা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাইছেন তাদের উদ্দেশ্য আছে। নির্বাচন বিলম্ব অথবা নির্বাচন বানচাল করতে চায় তারা।
ইসলামী আন্দোলনের সমাবেশে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি ছাড়া আগামী নির্বাচন দেশের মানুষ মানবে না। এ নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঐক্য তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, দৃশ্যমান সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে। যারা বলেন ক্ষমতায় গেলে সংস্কার করবেন, তারা কীভাবে বুঝলেন তারা ক্ষমতায় যাবেন? মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু কিছু আচরণ জনগণের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করেছে। নির্বাচনের আগে নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে নিজের মতামত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে কোনো নির্দিষ্ট দল বা ব্যক্তিকে সামনে রেখে কিছু হবে না। চব্বিশ-পরবর্তী বাংলাদেশে সবাই ঐক্যবদ্ধ। কারও অপপ্রচার বা প্রোপাগান্ডায় কিছু যায়-আসে না। গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, সকল রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ এ মঞ্চে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের জন্য একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব অ্যাডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রামানিকও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানান।
উল্লেখ্য, গেল বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই বিএনপি দ্রæত জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল। এক পর্যায়ে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের কাছে দাবি জানায় দলটি। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে হবে নির্বাচন। সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণা না হওয়ায় ভোট নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে। বিশেষ করে বিএনপিসহ আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও জোট ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের জন্য জোরালো চাপ সৃষ্টি করায় এক ধরনের উত্তেজনা ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে।
তবে চলতি মাসের ১৩ তারিখে লন্ডনে ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকের মধ্য দূর হয়ে যায় সকল ধরনের সংকট। বৈঠকের পর সরকার ও বিএনপির পক্ষ থেকে যৌথ বিবৃতিতে দিয়ে ঘোষণা করা হয়, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন। এই ঘোষণার পর দেশের রাজনীতিতে অনেকটা স্বস্তির পরিবেশ লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে ভোট নিয়ে যে সংশয় ছিল তা বিএনপির নেতাদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দূর হয়ে গেছে বলে মনে করছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।