গোটা দুনিয়ার মানুষ হয়তো ভেবে নিয়েছে ইসরায়েল-ইরানের যুদ্ধটি হয়তো অস্ত্রের। হ্যাঁ, ইসরায়েলের কাছে যুদ্ধটা অস্ত্রের। কিন্তু ইরানের জন্য যুদ্ধটা যতটা না অস্ত্রের, তার চেয়ে বেশি আত্মমর্যাদার। পার্সিয়ানরা জানে, এই যুদ্ধে তাদের ভরসা যতটা না অস্ত্রের ওপর, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি ভরসা ইতিহাসের ওপর।
হাজার বছর ধরে তারা আরব অঞ্চলে সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে বিজয়ের পতাকা নিয়ে বসবাস করছে। পার্সিয়ানরা সব সময় জাতিসত্তায় অত্যন্ত কঠোর, আত্মমর্যাদায় অবিচল। তাদের রয়েছে শক্তি, বুদ্ধি ও প্রতিপক্ষকে ঠান্ডা মাথায় ঘায়েল করার ক্ষমতা। যার কারণে পার্সিয়ানরা বারবার বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। এবারও ব্যতিক্রম নয় তারা।
স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়েও ইহুদিদের সঙ্গে অস্ত্র, বুদ্ধি ও কৌশলে সমান তালে লড়াই করছে। যেখানে ইসরায়েলের সঙ্গে রয়েছে বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সেখানে অনেকটা একা লড়াই করে ইসরায়েলের ঘরে কাঁপন ধরানোর জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইরান।
ইরানের চারপাশে রয়েছে বহু মুসলিম দেশ। কিন্তু কেউ সামরিক সাহায্য নিয়ে ইরানের পক্ষে এগিয়ে আসেনি। শুধু দু-লাইনের একটি বিবৃতি গণমাধ্যমে দিয়ে দায় সেরেছে আরবের দেশগুলো। এমনকি পাকিস্তানের মতো দেশও পিছিয়ে গেছে, বরং মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বুধবার বৈঠক করেছেন পাক সেনাপ্রধান।
বলতে দ্বিধা নেই, এই অঞ্চলের মিডিয়া ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের খবর অনেকটা বিনোদন সংবাদের মতো করে সাধারণ মানুষকে মনোরঞ্জন দেওয়ার জন্য পরিবেশন করছে। কিন্তু গণমাধ্যম পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী দুই দেশের সংঘাতের খবর যেভাবে প্রচার বা প্রকাশ করুক না কেন, প্রকৃত সত্য, এই সংঘাতে এখনো পর্যন্ত ইসরায়লের চেয়ে ইরানের ক্ষতি কয়েকগুণ বেশি।
গত ১৩ জুন ইরানের ওপর দানবীয় সার্জিক্যাল অপারেশন শুরু করে ইসরায়েল। অভিযান শুরুর পর থেকে ১৮ জুন বুধবার সন্ধ্যায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ইরানে রাজধানী তেহরান ও অন্যান্য শহরে নিহত হয়েছেন মোট ৫৮৫ জন। এই নিহতদের মধ্যে ১২৬ জনকে সামরিক এবং ২৩৯ জনকে বেসামরিক হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। ১২৬ জন সামরিক ব্যক্তির মধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক রয়েছে শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা। যারা প্রায় সকলেই ছিলেন দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির অত্যান্ত ঘনিষ্টজন।
এর মধ্যে ইসলায়েলের প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেই সঙ্গে বলেছেন আত্মসমর্পণ করার কথা। কিন্তু ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি ট্রাম্পের হুঁশিয়ারিকেও অসীম সাহসিকতার সঙ্গে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান সংঘাতে ইরান কখনও আপস করবে না বলে ঘোষণা করেছেন দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। ইসরায়েলের জায়নবাদী শাসকগোষ্ঠীকে কোনো দয়া দেখানো হবে না বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে পোস্ট করা এক বার্তায় খামেনি বলেন, আমরা অবশ্যই সন্ত্রাসী জায়নবাদীদের শক্ত জবাব দেব। ইরান কখনোই আপস করবে না। জায়নবাদীদের প্রতি কোনো দয়া দেখানো হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করতে বলার পর এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তিনি।
পার্সিয়ানরা দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিয়ে মেনে নিয়েছে, ইহুদিদের সঙ্গে আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচয়ের এই যুদ্ধে তারা যদি জয়ী হন, বিশ্ব ইতিহাস আবারো নতুন করে লিখতে হবে। আবার কোনো কারণে তারা যদি ইহুদিদের কাছে পরাজিত হয়, তাহলে পার্সিয়ানরা যে বীরের জাতি তা নতুন করে জানবে দুনিয়া। তাই মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও লড়াইয়ের ময়দান থেকে সামান্যতম পিছু হটছে না পার্সিয়ানরা, বরং প্রতিদিন নতুন উদ্যেমে সামর্থ্যরে সবটুকু দিয়ে ইসরায়েলজুড়ে তান্ডবলিলা চালাচ্ছে ইরান সামরিক বাহিনী।
গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় এই রিপোর্ট লেখার সময় জানা গেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য জড়িত থাকার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছেন। এ জন্য ১৮ জুন রাতে তিনি তার নিজস্ব জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু উভয়ের সঙ্গেই কথা বলেছেন।
এই পরিস্থিতিতে আমেরিকান সামরিক বাহিনী ইসরায়েলকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমেরিকান যুদ্ধবিমান, জ্বালানি ভরার বিমান ও বিমানবাহী রণতরী এই অঞ্চলের দিকে যাচ্ছে। এই খবর ইরান সামরিক বাহিনীর কাছে রয়েছে। তারা ভয় না পেয়ে উল্টো ইরানের পাশপাশের যেসব দেশে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে সেখানেও হামলার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়েছে খামেনি বাহিনী।
এছাড়া মঙ্গলবার রাতেও ইরান সামরিক বাহিনী নতুন করে ইসরায়েলজুড়ে হামলা চালিয়েছে। হামলার আগে ইসরায়েলের বাণিজ্যিক রাজধানী তেল আবিবের বাসিন্দাদের সরে যেতে বলেছিলেন ইরানি কর্মকর্তারা।