ই-পেপার বাংলা কনভার্টার শুক্রবার ● ১১ জুলাই ২০২৫ ২৭ আষাঢ় ১৪৩২
ই-পেপার শুক্রবার ● ১১ জুলাই ২০২৫
Select Year: 
ব্রেকিং নিউজ:




ডাবলিন সম্মেলন ২০২৫
তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
প্রকাশ: বুধবার, ১৮ জুন, ২০২৫, ২:৫২ পিএম  (ভিজিটর : ৩১০)
২০২৫ সালের ২৩ থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বৈশ্বিক সম্মেলন—World Conference on Tobacco Control (WCTC)। এই সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, নীতি নির্ধারক এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তামাক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই সম্মেলনের গুরুত্ব এমন এক সময়ে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, যখন বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ন সংকুচিত হচ্ছে, নীতি নির্ধারণে শিল্প মালিকদের প্রভাব বাড়ছে এবং গরিব ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে তামাক কোম্পানির আগ্রাসন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি হচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান ঠিক কোথায়? ২০০৪ সালে WHO FCTC (Framework Convention on Tobacco Control)-তে স্বাক্ষরকারী হিসেবে এবং ২০০৫ সালে ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন’ প্রণয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, গত এক দশকে আমাদের অর্জনগুলো অনেকটাই থমকে গেছে—কখনো প্রশাসনিক জড়তা, কখনো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, আবার কখনো শিল্প মালিকদের চাপের কাছে নীতিনির্ধারকদের আপসের কারণে।

বাংলাদেশে তামাকজনিত রোগে প্রতি বছর মারা যান প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ। এই মৃত্যু কেবল একজন ব্যক্তির নয়—এর সঙ্গে ধ্বংস হয় একটি পরিবার, একটি প্রজন্মের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। শুধু স্বাস্থ্য খাতেই নয়, তামাকের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও বিপুল ক্ষতি হচ্ছে। একদিকে সরকার যেমন রাজস্ব হারায়, অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়, কর্মক্ষমতা কমে যায়, এবং দারিদ্র্য বেড়ে যায়।

২০১৭ সালের পর বাংলাদেশে আর কোনো জাতীয় পর্যায়ের তামাক ব্যবহার সংক্রান্ত জরিপ হয়নি। ফলে বর্তমান পরিস্থিতি বোঝা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে যে তথ্যভিত্তিক পরিকল্পনার দরকার—তা অনুপস্থিত। GATS-এর সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী জনগণের মধ্যে তামাক ব্যবহারকারীর হার ৩৫.৩%। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধোঁয়াবিহীন তামাক—যেমন জর্দা, গুল, খৈনি—ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হয়। অথচ এসব পণ্যের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ, প্রচার-নিষেধ বা জনসচেতনতা কর্মসূচি অনেকটাই অনুপস্থিত।

বাংলাদেশে MPOWER কৌশলগত দিকনির্দেশনা কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে একাধিক দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়েছে। মনিটরিং বা তামাক ব্যবহার পর্যবেক্ষণে ঘাটতি, ধূমপানমুক্ত স্থানের বাস্তবায়নে শিথিলতা, তামাক ত্যাগে সহায়তা পরিষেবার অভাব, বিজ্ঞাপন ও প্রোৎসাহনে নির্মূল নিষেধাজ্ঞার দুর্বলতা এবং সর্বোপরি—কর কাঠামোর অসাম্য তামাক নিয়ন্ত্রণকে খণ্ডিত করেছে।

বিশেষ করে করনীতিতে আমাদের বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজন। আজও বিড়ি ও জর্দা পণ্যের ওপর করহার অত্যন্ত কম, যা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহজেই তামাক ব্যবহারে প্রলুব্ধ করে। ধনী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাক ব্যবহারের যে বৈষম্য তৈরি হয়েছে, তা স্বাস্থ্যগত বৈষম্যেও রূপ নিচ্ছে। অথচ প্রতিবেশী পাকিস্তান ২০২৩ সালে তামাক পণ্যের ওপর ১৫৪% পর্যন্ত কর বৃদ্ধি করে ব্যবহার হ্রাস এবং রাজস্ব বৃদ্ধির সফলতা দেখিয়েছে।

এছাড়াও তামাক কোম্পানির CSR কার্যক্রম, প্ররোচনামূলক বিপণন কৌশল এবং সরকারি মহলে লবিংয়ের কারণে আইন প্রয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। Global Tobacco Industry Interference Index ২০২৩ অনুযায়ী, তামাক শিল্পের হস্তক্ষেপ প্রতিরোধে বাংলাদেশ সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে। এটি শুধু উদ্বেগজনকই নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্যের জন্য এক ধরনের হুমকি।

তবে সব অন্ধকারে আলো রয়েছে। বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের তামাক নিয়ন্ত্রণে অবদান অনেক পুরনো ও শক্তিশালী। নারী নেতৃত্বাধীন জোট তাবিনাজ, গবেষণা সংস্থা উবিনীগ সহ অনেক প্রতিষ্ঠান মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। তারা শুধু সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে না, বরং গবেষণা, আইন সংশোধন প্রস্তাবনা, মিডিয়া অ্যাডভোকেসি ও তরুণদের সংগঠিত করেও ভূমিকা রাখছে।

ডাবলিন সম্মেলন তাই বাংলাদেশ সরকারের জন্য কেবল আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশগ্রহণের সুযোগ নয়—এটি অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের সংকেত। এই সম্মেলন থেকে ফিরে এসে প্রতিনিধিরা যেন কেবল রিপোর্ট লেখেন না; বরং এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে একটি সময়োপযোগী, কার্যকর এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

সরকার চাইলে, আগামী এক বছরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে পারে:

 ১) ধোঁয়াবিহীন তামাক ও বিড়ির ওপর কর বৃদ্ধি এবং কর কাঠামোর সরলীকরণ;
 ২) সর্বজনীন ধূমপানমুক্ত আইন বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত জনবল ও জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থা;
 ৩) তামাক ত্যাগে সহায়তা পরিষেবা চালু, যেমন জাতীয় হেল্পলাইন, উপজেলা পর্যায়ে কাউন্সেলিং সেন্টার;
 ৪) প্লেইন প্যাকেজিং এবং চিত্রসহ সতর্কবাণীর ঘন ঘন পরিবর্তন নিশ্চিত করা;
 ৫) তামাক শিল্পের হস্তক্ষেপ ঠেকাতে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।

ডাবলিন সম্মেলন ২০২৫ হতে পারে বাংলাদেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের নতুন দিগন্ত। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক উদ্যোগ এবং নাগরিক সমাজের সহযোগিতায় আমরা এখনো দক্ষিণ এশিয়ায় নেতৃত্ব দিতে পারি। ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যে ঘোষণা আমরা দিয়েছি—তার জন্য এখনই শুরু করতে হবে একটি দায়িত্বশীল, সাহসী ও সময়োপযোগী যাত্রা। 


সীমা দাস সীমু
পরিচালক
উবিনীগ







সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক : কে.এম. বেলায়েত হোসেন
৪-ডি, মেহেরবা প্লাজা, ৩৩ তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত এবং মনিরামপুর প্রিন্টিং প্রেস ৭৬/এ নয়াপল্টন, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
বার্তা বিভাগ : ৯৫৬৩৭৮৮, পিএবিএক্স-৯৫৫৩৬৮০, ৭১১৫৬৫৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন ঃ ৯৫৬৩১৫৭, ০১৭১২-৮৮৪৭৬৫
ই-মেইল : [email protected], [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
বার্তা বিভাগ : ৯৫৬৩৭৮৮, পিএবিএক্স-৯৫৫৩৬৮০, ৭১১৫৬৫৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন ঃ ৯৫৬৩১৫৭, ০১৭১২-৮৮৪৭৬৫
ই-মেইল : [email protected], [email protected]