মো. কামরুজ্জামান কামরুল
প্রায় দুই কোটি মানুষের আবাসস্থল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ না থাকায় এ দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক কেন্দ্রস্থল এই শহর। নানাবিধ অনিয়মের কারণে হাজারো সমস্যায় জর্জরিত ঢাকা। এগুলোর মধ্যে কোন সমস্যাটিকে যে এক নম্বরে ফেলা যায়, তা গবেষনার বিষয়বস্তু। তবে প্রতিনিয়ত মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে যে সমস্যায়, সেটি হলো যানজট। ঢাকা শহরের যানজট সমগ্র দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে বলে এটিকে এখন জাতীয় সমস্যা বলা যায়। কর্মের প্রয়োজনে যারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় আসেন, যানজটের কারণে ঢাকা শহর তাদের কাছে আতংকের শহর হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাখো লাখো যানবাহন ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, এমনকি যানবাহনের চাপাচাপিতে পায়ে হাঁটার পথও অবরুদ্ধ হয়ে যায়। হাসপাতালে যাওয়ার পথে কত রুগী যে যানজটে পড়ে রাস্তাতেই মৃত্যুবরণ করে তার ইয়ত্তা নেই।এই যানজটের কারণে মানুষের কর্মঘন্টা নষ্ট হয়, যানবাহন থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া শহরের বাতাসকে ভারী করে তোলে, যাত্রীদের ভাড়ায় চালিত গাড়ীর ভাড়া গুনতে হয় বেশী, ছাত্র-ছাত্রীদের অমানুষিক ভোগান্তিতে পড়তে হয় হরহামেশা।
যানজটের কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে নগরবিদদের বয়ানে উঠে আসে যে বিষয়গুলো, তার মধ্যে অন্যতম রাস্তার স্বল্পতা, অতিরিক্ত যানবহনের চাপ, অপরকল্পিত নগরায়ন, অপরিকল্পিত সড়ক নকশা, জনসংখ্যার অস্বাভাবিক ঘনত্ব, গনপরিবহনের অব্যবস্থাপনা ও স্বল্পতা, ভেঙ্গে পড়া ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অবৈধ পার্কিং, হকারদের রাস্তা দখল, প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে রিক্সার মতো স্বল্প গতির বাহনের চলাচল ইত্যাদি।
একটি পরকল্পিত আধুনিক শহরে রাস্তা থাকার নিয়ম শহরের মোট আয়তনের শতকরা পঁচিশ ভাগ। কিন্তু ঢাকা শহরে আছে মাত্র শতকরা আট ভাগ। সেই শতকরা আট ভাগের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেদখল হয়ে থাকে। ঢাকার ফুটপাতগুলো দখল করে থাকে ফুটপাথের পাশের দোকানগুলো। ফুটপাথ ছেড়ে নীচে নেমে এসে রাস্তার উপর ভ্যানে করে পসরা সাজিয়ে বসে হকাররা। ফলে পথচারীরা ফুটপাথ ছেড়েরাস্তার মধ্য দিয়ে যত্রতত্র চলাফেরা করেন। এতে করে রাস্তা সংকীর্ন হয়ে যায় এবং যানবাহনের গতি কমে যানজটের সৃষ্টি হয়। এছাড়াও সরকারী বিভিন্ন সংস্থার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িও যানজটের অন্যতম কারণ। নগরের বিভিন্ন রাস্তার দুই পাশে রিক্সার গ্যারেজ, মোটর গাড়ী ও মটরসাইকেল রিপিয়ারিংয়ের ওয়ার্কশপ রাস্তাকে সংকীর্ন করে ফেলে।যদি এ বিষয়গুলো না থাকতো, তাহলে ঢাকা শহরে প্রতিদিন চলাচলকারী দশ লাখ যানবাহন আয়েশে চলতে পারতো, কোন জট তৈরি হতো না। ইদানিং যানজটের একটি বৃহৎ কারণ রাস্তা দখল করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, পেশজীবি সংগঠন, পাড়াভিত্তিক-মহল্লাভিত্তিক সংগঠনের মিছিল, মিটিং, অবরোধ, ব্লকেড, মানববন্ধন কর্মসুচি পালন।এরা রাস্তা দখল করে কখনো বৃহৎ জনসমাবেশ করে। আবার মাত্র কয়েক হালি বা কয়েক ডজন মানুষ নিয়ে গলা ফাটিয়ে চীৎকার করে রাস্তা দখল করে রাখে। তাদের পেছনে যে শত-শত, হাজার-হাজার গাড়ী বা মানুষ আটকা পড়ে অমানুষিক কষ্ট ভোগ করছে, তাতে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে প্রতিদিন মানববন্ধনের নামে গ্রুপ গ্রুপ হয়ে হাতে গোনা কিছু মানুষ বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানার ঝুলিয়ে, মাইক লাগিয়ে, গলার রগ ফুলিয়ে গর্জন করেন। এসব গর্জনকারীরা ছোট ছোট দলের বড় বড় নেতা। এই জনদরদী নেতারা নানান কিছিমের দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রতিদিনই এখানে হাজির হন। কর্মকর্তা-কর্মচারি-শ্রমিক – সকলেরই সাপ্তাহিক ছুটি আছে। কিন্তু এই আন্দোলন-শ্রমিকদের কোন সাপ্তাহিক ছুটি নেই। এতে শ্রম আইন লংঘন হচ্ছে কিনা ভেবে দেখা দরকার! যাইহোক, উনাদের দাবী পুরন হোক বা না হোক, যানজট যে সৃষ্টি হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ব্লক হয়ে গেলে পুরানা পল্টন, নয়া পল্টন, মতিঝিল, গুলিস্তান, বিজয়নগর পর্যন্ত যানজট সৃষ্টি হয়। সমাবেশ বড় হলে যানজট শাহবাগ, এলিফেন্ট রোড, হেয়ার রোড, শেরাটন মোড় হয়ে বাংলামোটর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।
মিছিল, মিটিং, ব্লকেডের অপর একটি প্রাইম পয়েন্ট হলো শাহবাগ।বলা যায়, হাল আমলে দাবী আদায়কারীদের তীর্থস্থান এই শাহবাগ মোড়। ইউনুস সাহেব ক্ষমতায় আসার পর শাহবাগ আবরোধ করে যারা কোন দাবী করতে পেরেছেন, তারাই সফলকাম হয়েছেন। জনাব ইউনুসের শাহবাগের প্রতি বিশেষ একটি দুর্বলতা আছে বলে মনে হয়। একটি কাওয়ালি গানের কথা মনে পড়ে গেল ‘কেউ ফেরে না খালি হাতে, খাজারে তোর দরবারে’। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো গানের কথা সামান্য পরিবর্তন হয়ে এমন হতে পারে ‘কেউ ফেরে না খালি হাতে ইউনুসের শাহবাগে’। শাহবাগের রাস্তা অবরোধ করলে ঢাকা শহরের প্রায় অর্ধেক এলাকায় যানজট তৈরি হয়। সেদিকে দৃষ্টি দেবার সময় কোথায় বর্তমান অন্তর্বর্তি সরকারের। বরঞ্চ স্নেহধন্য যানজট সৃষ্টিকারীদের উপর সরকারী উদ্যোগে ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে সরকার তাদের আশীর্বাদ বর্ষন করেন। নিন্দুকেরা বলেন, শুধু ঠান্ডা পানি নয়, সরকারী খরচে গরম বিরিয়ানিও বর্ষিত হয়। আন্দোলনের নামে মব সৃষ্টিকারীদের প্রতি এই স্নেহ প্রদর্শনই বলে দেয়, এই সরকারের প্রাণ ভোমরা পোঁতা রয়েছে শাহবাগ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি পর্যন্ত এলেকায়।
রিক্সার জন্য ঢাকা শহরের বিশ্বব্যাপী খ্যাতি আছে। এক সময় ঢাকাকে মসজিদের শহর বলা হতো। এখন বলা হয় রিক্সার শহর। কিছুদিন আগেও স্বল্প গতির প্যাডেলচালিত রিক্সা শহর দাপিয়ে বেড়াত। যদিও পুলিশের নির্দেশনা ছিল, শুধু গলিপথ এবং কিছু নির্ধারিত কম ব্যাস্ত রাস্তায় রিক্সা চলবে। কিন্তু তৎকালীন সড়কমন্ত্রি ওবায়দুল কাদেরের সুব্যবস্থাপনায় পুলিশকে কিছু উৎকোচ দিয়ে রিক্সা চলতো ভিআইপি রোডেও।শেখ হাসিনার ক্ষমতার শেষ দিকে হঠাৎ ঢাকার রাস্তায় উদয় হলো ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা। এগুলো ঢাকার প্রধান সড়ক, ভিআইপি সড়ক – সবখানে চলতে লাগলো। পুলিশের পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা হলো। কিন্তু পুলিশ, নগর পরিকল্পনাবিদ – কারও সঙ্গে কোন আলোচনা না করেই তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার রাস্তায় অটোরিক্সা চলার অনুমতি দিয়ে দিলেন। তিনি আরো বললেন, ব্যাটারিচালিত রিক্সা আমাদের ‘টেসলা’। আর পায় কে? বায়োনিক গতিতে দাপটের সঙ্গে চলাচল করে ঢাকার রাস্তায় যানজট তৈরি করে তারা সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তুললো। এর কিছুদিন পরেই সরকার পরিবর্তন। শুরু হলো মব ভায়োলেন্স আর রাস্তা অবরোধ করে নাগরিকদের জিম্মি করার মহোৎসব। শাহবাগ হয়ে উঠলো এসবের প্রাণ কেন্দ্র। এই মহোৎসবের মাঝেই কোন এক শুভদিনে ব্যাটারিচালিত রিক্সা চালকরা তাদের বৃহত্তর দাবি-দাওয়া নিয়ে শাহবাগে হাজির। স্লোগান তুললেন, ‘তুমি কে, আমি কে – ব্যাটারি, ব্যাটারি’। তান্ডব সৃষ্টি করলেন রাজপথে। এদিকে যানজটে পথচারীদের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। প্রশাসন নির্বিকার। পুলিশ চুপচাপ। বোঝা গেল, শেখ হাসিনা ও ইউনুসের কল্যাণে এবং রিক্সাচালকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আমরা ব্যাটারি যুগে প্রবেশ করেছি। ‘টেসলা’ এখন আমাদের প্রধান বাহন। এত বড় অর্জন! এ অর্জনকে জাতীয়ভাবে উদযাপন করা যেতে পারে। প্রযুক্তির শীর্ষে পোঁছে যাওয়ার বিপরীতে, ঢাকা শহরের এই সামান্য যানজট পরিমানের বিচারে নস্যি!!
ঢাকা শহরের যানযট এক মানবিক বিপর্যয়সৃষ্টি করেছে। যানজটের প্রভাবে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত এই শহরের মানুষ।গন্তব্যে বা কর্মস্থলে পৌঁছাতে ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় থাকতেহয়। শুধু ঢাকা শহরে যানজটের কারণে প্রতদিন ৩৫ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হয়। অফিস - কারখানায় কাজের গতি কমে যাওয়া, জ্বালানির অপচয় ইত্যাদি কারণে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। যানজটে আটকে থাকা গাড়ী থেকে নির্গত ধোঁয়া ও শব্দ ক্রমাগত পরিবেশ দূষণ করছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্নক ক্ষতিকর।যানজটের কারণে অবসাদ, উদ্বেগ, ধৈর্য্য হারানোসহ নানাবিধ মানসিক বৈকল্য সৃষ্টি হয়।
ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে স্বল্প মেয়াদী, মধ্য মেয়াদী এবং দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্প হাতে নিতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিতে হবে দেশপ্রেমিক রাজনীতিক, টেকনোক্র্যাট এবং বেসামরিক-সামরিক আমলাদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির হাতে। স্বল্প মেয়াদে থাকবে এক মাসের মধ্যে রাস্তা-ফুটপাত দখলমুক্ত করা। এক্ষেত্রে যুগপৎভাবে দখলকারীদের সচেতন করে আইন মানতে উৎসাহিত করতে হবে এবং কঠিন হয়েধারাবাহিকভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে। সমস্যার অর্ধেক সমাধান এখানেই হয়ে যাবে। মধ্যমেয়াদী প্রকল্পে থাকবে শহরের ভেঙ্গে পড়া ট্রাফিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং আধুনিকায়ন করা। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রনে ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে।বর্ষায় রাস্তা ডুবে যাওয়ার করনে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয় ঢাকা শহরে। ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা কঠিন কোন বিষয় নয়। এক্ষেত্রে দূর্নীতিমুক্ত হয়ে সরকারের বিভিন্ন বিভাগসমূহের মধ্যে সমন্বয় করে অপরিকল্পিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করতে হবে। এতে করে যানজট সমস্যার উল্লেখযোগ্য সমাধান সম্ভব। মধ্যমেয়াদী প্রকল্প এক বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের জন্য পাঁচ বছরের পরিকল্পনা থাকতে হবে। এক্ষত্রে ঢাকা শহরে পুর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিনব্যাপি অনেকগুলো মেট্রোরেল বাস্তবায়ন করতে হবে। মেট্রোরেল ঢাকা শহরের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। পাখীর চোখে দেখলে দেখা যায়, ফ্লাইওভার ঢাকা শহরকে মাকড়সার জালের মতো ঘিরে আছে। ফ্লাইওভারগুলোও যান চলাচলে বেশ ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। তবে যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে মেট্রোরেল প্রশ্নাতিতভাবে সফল একটি ব্যবস্থা।
যানজট ঢাকা শহরের বহুমাত্রিক, জটিল এবং দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। এই সমস্যার সঠিক সমাধান করতে না পারলে রাজধানী বাঁচবে না, দেশের অর্থনীতি বাঁচবে না, সকল উন্নয়ন ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই আগ্রাধীকারের ভিত্তিতে ঢাকার যানজট সমস্যার সমাধান জরুরী।
লেখক : সাংবাদিক,কলামিস্ট।