দেশের মিঠাপানির মাছের বড় উৎস হিসেবে খ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওরের পানিতে মিলেছে উচ্চমাত্রার ভারী ধাতু। গত এপ্রিলে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলোজির একদল গবেষকের করা গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
এতে দেখা যায়, টাঙ্গুয়ার হাওরের পানিতে অতিমাত্রায় ভারী ধাতুর উপস্থিতি রয়েছে। হাওরের ১২টি আলাদা জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করার পর এমন তথ্য বেরিয়ে আসে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন ও পর্যটকদের ফেলা বর্জ্য।হাউজবোটগুলো থেকে প্লাস্টিক বোতল, পলিথিন থেকে শুরু করে রান্নার সব ধরনের বর্জ্য ফেলা হয় হাওরে। এ ছাড়া কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জমিতে দেওয়া হয় কীটনাশক। কীটনাশকও ভারী ধাতুর জন্য দায়ী। সবচেয়ে বেশি দায়ী শিল্পবর্জ্য।
গবেষণায় উঠে এসেছে, হাওরের ভূ-উপরিস্থ পানিতে ছয় ধরনের ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে। সেগুলো হলো নিকেল, ক্রোমিয়াম, সিসা, জিংক, তামা ও ম্যাঙ্গানিজ। ১২টি স্থানের মধ্যে বারেক টিলার পানিতে সবচেয়ে বেশি দূষিত ধাতুর উপস্থিতি মিলেছে।
গবেষকরা বলছেন, এসব ধাতু মানবস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকারক। ভারী ধাতুর পানিতে বড় হওয়া মাছ খেলে প্রাণঘাতী ক্যান্সারও হতে পারে।
তারা আরো বলছেন, ১২টি নমুনার মধ্যে সবেচেয়ে বেশি মাত্রায় ভারী ধাতু পাওয়া গিয়েছে ক্রোমিয়াম ও নিকেল। প্রতি লিটার পানিতে গড়ে ক্রোমিয়াম পাওয়া গিয়েছে দশমিক ৩৬৪ গ্রাম।
নিকেল পাওয়া গিয়েছে দশমিক ৩৭৩, যা অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে অনেক গুণ বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা অনুযায়ী প্রতি লিটার পানিতে ক্রোমিয়ামের অনুমোদিত সর্বোচ্চ মাত্রা দশমিক শূন্য ৫ মিলিগ্রাম। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি লিটার পানিতে নিকেলের অনুমোদিত সর্বোচ্চ মাত্রা দশমিক শূন্য ৭ মিলিগ্রাম ও বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা অনুযায়ী যা দশমিক শূন্য ২ মিলিগ্রাম। অন্যান্য ভারী ধাতুর মধ্যে ১২টি নমুনায় প্রতি লিটার পানিতে জিংক দশমিক ২১০, তামা দশমিক ২১৭, ম্যাঙ্গানিজ দশমিক ১৫৩ ও সিসা দশমিক ১০৮ মিলিগ্রাম পাওয়া গেছে, যা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি।
গবেষকদের সাথে একমত পোষন করে স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা জনাশিউস এর সভাপতি এবং জলবায়ু ও পরিবেশ বিষয়ক গণমাধ্যমকর্মী সাজেদা আহমেদ বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের পানিতে যে ক্ষতিকারক ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে, এর প্রথম কারন গত তিন দশক ধরে হাওরের আশপাশে ক্রমবর্ধিষ্ণু বিভিন্ন প্রকৃতি ও পরিবেশ বিধ্বংসী দূর্বৃত্তায়ন। তিনি বলেন, ৮০’র দশকে সবুজ বিপ্লবের নামে এদেশে কর্পোরেট বা রাসয়নিক কৃষির আমদানী করা হয়। হাওরের চিরায়ত কৃষি অধিক ফলনের প্রতিযোগিতায় কর্পোরেট কৃষির কাছে হেরে যেতে যেতে এখন বিলুপ্তির তালিকায় নাম লিখিয়েছে। গত ২৫-৩০ বছর ধরে বিদেশী বহূজাতিক কোম্পানি নির্ভর কৃষির ফাঁদে হাওরের কৃষকরা আটকে পড়েছে। সরকারী কৃষি বিভাগের লোকজনও কোম্পানির রাসয়নিক কৃষি উপকরণের প্রেসক্রিপশন দিয়ে মাটি ও জলের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক সার, কীটনাশক জাতীয় দ্রব্যের ব্যপক ব্যবহারে বাধ্য করেছে কৃষককে।
টাঙ্গুয়ার হাওর তীরবর্তী জনপদের কৃষক এবং কৃষিব্যবস্থাও এই আগ্রাসনের শিকার। আর এভাবেই হাওরের জলে বিষের প্রভাব ক্রমাগত বাড়ছে।
দ্বিতীয় কারন হলো, পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানোর নামে টাঙ্গুয়ার হাওরকে একটা প্রাণহীন বিষাক্ত জলাভূমি বা মৃত জলাভূমিতে পরিনত করা হচ্ছে। ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক রামসার সম্মেলনে বিশ্বের ‘গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি’ অথচ ‘প্রতিবেশগত বিপন্ন এলাকা’ এই ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশের একমাত্র জলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওরকে রামসার সাইট হিসেবে তালিকাভুক্ত করে এবং এটিকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষনা করে। এরপর টাঙ্গুয়ার হাওরের বিপন্নতা কাটিয়ে উঠতে দেশী বিদেশী বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি বাংলাদেশের সাথে অংশীভূত হয়ে কাজ শুরু করে। কিন্তু দেশী-বিদেশী টাকার অপব্যয় ও লুটপাঠ ছাড়া কিছুই দেখা যায়নি। এখন গত ৫-৬বছর ধরে টাঙ্গুয়ার হাওরকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে তুলে ধরতে ব্যাস্ত হয়ে উঠেছে একশ্রেণীর চিন্তা বিলাসী আমলা, চাটুকার ও লুটেরা উন্নয়নকর্মী এবং কতিপয় অতিউৎসাহী গণমাধ্যমকর্মী। এটা যে মুমুর্ষ বা বিপন্ন একটা জলাভূমির জন্য ‘মরার উপর খারার ঘা’, তা কেউই ভাবছেনা। খোঁড়া যুক্তির হাঁড়িকাঠে বলি হচ্ছে প্রকৃতির বৃক্ক টাঙ্গুয়ার হাওর নামের এই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমিটি।
তৃতীয়ত, শিল্পবর্জ্য বা সবচেয়ে বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য টাঙ্গুয়ার হাওরে আসতে শুরু করেছে সেই ৮০র দশক থেকেই। ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ে খনিজ উত্তোলনের নামে যত্রতত্র মাইনিং, কোল-স্টোন মাইনিংয়ে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন পয়েজনাস কেমিক্যালের ব্যাপক ব্যবহার করা হয়ে আসছে। আর প্রতিবার বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢলের সাথে এসব বিষাক্ত রাসয়নিক বর্জ্য সরাসরি টাঙ্গুয়ার হাওরে নেমে আসে।
এই তিনটি বিষয় নিয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ না নিতে পারলে, টাঙ্গুয়ার জল বিষে পরিনত হবে। এই হাওরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জনবসতি বাঁচতে হলে মাইগ্রেট করতে হবে নতুন ভূমিতে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক এএসএম সাইফুল্লাহ বলেন, ‘পানিতে যখন দূষণ ছড়িয়ে পড়ে সেটা মাছসহ জলজ প্রাণীর ওপর প্রভাব ফেলে। ভারী ধাতুর দূষণ মাছে জমা হয়। সে মাছ খেলে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকিও থাকে। তাছাড়া হাওর এলাকায় পর্যটকদের জন্য ওই পানি দিয়েই রান্না হয়। এটা আরো ঝুঁকিপূর্ণ।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান বলেন, ‘টাঙ্গুয়ারসহ দেশের অন্যান্য হাওর ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা একটি মাস্টারপ্ল্যান করছি। এ নিয়ে এরই মধ্যে স্থানীয়ভাবে বিশেষজ্ঞ ও সেখানকার বাসিন্দাদের মতামত নেয়া হয়েছে। হাওরে যেমন পর্যটন বিকাশের সুযোগ রয়েছে, তেমনি আছে কৃষি ও মৎস্য উৎপাদনের সম্ভাবনা। এসব সম্ভব হবে যদি হাওর সুরক্ষিত থাকে। হাওরের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাস্টারপ্ল্যানে সেই বিষয়গুলোও বিবেচনায় নেয়া হবে।