সংকট নিরসনে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি বিএনপির
দফায় দফায় বৈঠক করছেন রাজনৈতিক নেতারা

গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুঞ্জন রটে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করবেন। এই গুঞ্জনের মধ্যেই জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসমাল ছুটে যান যমুনায়। বৈঠক করেন প্রফেসর ড. ইউনূসের সঙ্গে। ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক শেষে যমুনা থেকে বের হয়ে বিবিসি বাংলাকে নাহিদ ইসলাম জানিয়ে দেন, গুঞ্জন নয়, সত্যিই ড. ইউনূস সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগের চিন্তা করছেন। নাহিদ ইসলামের এই বক্তব্য মুহূর্তের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যায়। নাহিদের পর সরকারে থাকা দুই ছাত্র উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন। শুরু হয় রাজনৈতিক নেতাদের ছোটাছুটি। বিশেষ করে জুলাই আন্দোলনের পক্ষের প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের নেতারা নিজেদের মধ্যে বৈঠক শুরু করেন। মধ্যরাতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পল্টন অফিসে পাঁচটি রাজনৈতিক দলের নেতারা মিলিত হয়ে জরুরি বৈঠক করেন। ইসলামী আন্দোলন ছাড়া বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোটের নেতারা। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান ভার্চুয়ালি বৈঠকে অংশ নেন। বিএনপি নেতারাও নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেন। লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গেও বিভিন্ন দলের নেতারা টেলিফোনে কথা বলেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে। এছাড়া গতকাল সারাদিন বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের নেতারা। হয়েছে দফায় দফায় বৈঠক। বিএনপি ছাড়াও বিভিন্ন দলের নেতারা ড. ইউনূসকে পদত্যাগ না করতে আহ্বান জানিয়েছেন। যে কোনো সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জন এবং রাজনীতির টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে ফেসবুকে এক পোস্ট দেওয়ার কিছুক্ষণ পর আবার তা সরিয়ে নেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তিনি লিখেছিলেন, অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষমতা প্রয়োজন নেই, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ ডেমোক্রেটিক ট্রাঞ্জিশনের জন্য ড. ইউনূস স্যারের দরকার আছে। প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন না, এমন আশা ব্যক্ত করে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ওই ফেসবুক পোস্টে বলেন, ক্যাবিনেটকে আরও গতিশীল হতে হবে। সরকারকে আরো বেশি ফাংশনাল হতে হবে, উপদেষ্টাদের আরো বেশি কাজ করতে হবে, দৃশ্যমান অগ্রগতি জনতার সামনে উপস্থাপন করতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। আমাদেরকে দেখাতে হবে যে, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তীতে জনতার সম্মতিতে ক্ষমতায় এসে প্রফেসর সাফল্য দেখিয়েছেন। গতকাল দুপুরে নিজের ফেসবুক পাতায় ওই পোস্ট দেন ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। কিন্তু বিকেল থেকে সেই পোস্ট আর দেখা যায়নি।
এদিকে দেশের রাজনীতির টালমাটাল অবস্থা ও অস্থিরতা নিরসনে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত বলে মনে করছেন বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এছাড়া কেউ কেউ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিরাজমান বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে দ্রুত ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য জয়নুল আবেদিন ফারুক বলেন, দেশে এখন একটি অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই অস্থিরতার হোতা কারা? কারা এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে? কারা নির্বাচনে বিলম্ব ঘটাতে চায়? আমরা এই প্রশ্নগুলো অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো মহান ব্যক্তির কাছেই রেখেছিলাম। তিনি নাকি বলেছেন, জুলাইয়ে নির্বাচন হবে। তিনি আরও বলেন, যদি নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়া হতো তাহলে আমরা যারা আন্দোলনে ছিলাম, মামলা খেয়েছি, হাসিনার শাসনামলে কারাভোগ করেছি, তারাও আপনার (ইউনূস) সঙ্গে বসতে পারতেন। কিন্তু এখনো নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি। তাই আমরা মনে করি, অস্থিরতার পেছনে যদি আপনারা দায়ী থাকেন, তাহলে বিএনপি কখনোই তা মেনে নেবে না।
এদিকে বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিরাজমান বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে দ্রুত ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়নের জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব। তিনি বলেন, চলমান সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে অবিলম্বে ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন এবং তার ভিত্তিতে নির্বাচনের আয়োজনই হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এই মুহূর্তের জরুরি করণীয়। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান তিনি। জেএসডি সভাপতি বলেন, ফ্যাসিবাদী শাসনের বিপরীতে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণভিত্তিক, গণমুখী ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি সমন্বিত, সর্বজনীন ও গণভিত্তিক প্রজাতন্ত্র গঠনে জুলাই অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে সংস্কারের লক্ষ্যে ‘জাতীয় সনদ’ দ্রুত প্রণয়ন এই মুহূর্তে অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এছাড়া বিচার, সংস্কার ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ না থাকায় দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। গতকাল দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি আয়োজিত শ্রমিক সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন। তবে শুধু নির্বাচনের জন্য বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়নি উল্লেখ করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সভার পর অনেক আলোচনা করেছি। আমাদের তিনটা কঠিন দায়িত্ব, এর একটি সংস্কার, অন্যটি বিচার, আরেকটি নির্বাচন। শুধু নির্বাচন করার জন্যই আমরা দায়িত্বটা নেইনি। গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে বাংলাদেশ প্রাণিবিদ্যা সমিতির ২৪তম জাতীয় সম্মেলন এবং বার্ষিক সাধারণ সভা শেষে সাংবাদিকদের এ সব কথা বলেন তিনি।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তার একদিনও এদিক-সেদিক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কাজেই এগুলো নিয়ে অন্য ধরনের কথা বলাও উচিত ছিল না। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা যদি দায়িত্ব পালন করতে পারি, তাহলে আমাদের দায়িত্বে থাকাটা প্রাসঙ্গিক। আর যদি দায়িত্ব পালন করতে না পারি, তখন দায়িত্ব পালন করাটা আর প্রাসঙ্গিক থাকল না।
ছাত্রজনতার প্রবল আন্দোলনে গত বছর ৫ আগস্ট সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার তিন দিন পর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এর সাড়ে নয় মাস পর নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও অভ্যুত্থানের নেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ভিন্ন অবস্থান, ও ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের শপথ পড়ানো নিয়ে আন্দোলনের মধ্যে বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্যের ঘটনা ঘটে। দুই পক্ষই কিছু উপদেষ্টাদের পাল্টাপাল্টি পদত্যাগ দাবি করে।