যুক্তরাষ্ট্র থেকে অন্য দেশে টাকা পাঠাতে হলে নাগরিক নয় এমন এমন ব্যক্তিদের ৫ শতাংশ কর পরিশোধের নতুন আইন শিগিগির পাস হতে যাচ্ছে। এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট’ নামে প্রস্তাবটি করেন। ১৮ মে (রবিবার) মার্কিন কংগ্রেসের বাজেট কমিটিতে মাত্র ১ ভোটের ব্যবধানে তা পাস হয়েছে। নতুন এ আইন পাস হলে ভোগান্তিতে পড়বে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত হাজার হাজার বাংলাদেশি।
এ বিলে কর হ্রাস, সরকারি ব্যয় হ্রাস এবং সীমান্ত নিরাপত্তা উন্নত করার পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অন্যান্য দেশে অর্থ স্থানান্তরের (রেমিট্যান্স) উপর ৫ শতাংশ নতুন কর আরোপ করা। খবর এনডিটিভির।
ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট-এ বলা হয়েছে, সমস্ত রেমিট্যান্সের উপর ৫ শতাংশ কর ধার্য করা হবে। কর সংগ্রহ করবে মার্কিন ব্যাঙ্ক বা পরিষেবা প্রদানকারীরা। তারাই এ কর সংগ্রহ করে সরকারকে দেবে। যদি স্থানান্তরের সময় কর পরিশোধ না করা হয়, তাহলেও পরিষেবা প্রদানকারী দায়ী থাকবে।
মার্কিন নাগরিক এবং দেশেই যাদের জন্ম তারা এ করের আওতাভূক্ত থাকছেন না। তাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ দেখাতে হবে এবং মার্কিন কোষাগারের সঙ্গে একটি বিশেষ চুক্তি করতে হবে। প্রেরিত অর্থের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে এ বিলে কোনও কর ছাড় দেওয়া হয়নি। এর অর্থ হল প্রেরক যদি মার্কিন নাগরিক না হন তবে ছোট স্থানান্তরের উপরও কর আরোপ করা হবে।
এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে ভারত। কারণ ভারত আমেরিকা থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ রেমিট্যান্স পায়। ২০২৩-২৪ সালে ভারত ১১৮.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পেয়েছিল। এর ২৭.৭ শতাংশ এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এই রেমিট্যান্সের বেশিরভাগই আসে এইচ ১ বি এবং এল ১ ভিসায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত ভারতীয়দের কাছ থেকে। প্রকৃতপক্ষে, গত বছরে জারি করা H-1B ভিসার ৭০ শতাংশেরও বেশি ভারতীয় কর্মীদের থেকেই গিয়েছে।
বিলটি এখন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে পূর্ণাঙ্গ ভোটের অপেক্ষায়। পাস হলে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা প্রায় ৪৫ লাখ ভারতীয় এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে বড় প্রভাব পড়তে পারে।
টাইমস অব ইন্ডিয়া প্রতিবেদনে জানায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স প্রেরণে কর কার্যকর হলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে ভারতীয় অভিবাসীদের মধ্যে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৪৫ লক্ষ ভারতীয় রয়েছেন, যার মধ্যে ৩২ লক্ষ ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং তাদের কয়েক লক্ষাধিক নন সিটিজেন। এসব বসবাসরত এবং কাজ করা লক্ষাধিক ভারতীয়, যারা নিয়মিতভাবে দেশে অর্থ পাঠান। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রায় ৩২ বিলিয়ন ইউএস ডলার।
অপরদিকে বাংলাদেশে গত কয়েক মাসে রেকর্ড রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। এরমধ্যে গত জানুয়ারি থেকে টানা সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স পাঠানোর তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র স্থান করে নিয়েছে। গত মার্চ মাসে রেকর্ড ৫৪ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার ডলার যায় বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কয়েক লাখ বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত অভিবাসী রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে।
যার বৃহৎ একটি অংশ নন সিটিজেন হিসেবে এদেশে অবস্থান করছেন। কর কার্যকর হলে রেমিট্যান্স খাতে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশী প্রবাসীদের মধ্যে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রয়া সৃষ্টি হয়েছে।
নিউইয়র্কে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশি আবুল কালাম ১৫ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। নিউ জার্সির একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করেন দৈনিক ১০-১২ ঘণ্টা। নিজের খরচ বাঁচিয়ে প্রতি মাসেই কিছু ডলার পাঠান গ্রামের বাড়িতে, তার পাঠানো অর্থেই চলে গ্রামের বাড়ির সংসার, মেয়ের পড়াশোনা, ছোট ভাইয়ের ওষুধ। পরিবারে তিনজন নির্ভরশীল — সবাই রেমিট্যান্সনির্ভর।
কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে প্রস্তাবিত একটি আইনের খবরে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন আবুল কালাম। আবুল কালাম বলেন, “যদি এই কর বসে, আমাদের মতো প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি কষ্টে পড়বে। আর দেশে আমার মা, মেয়েরাও।”
বাংলাদেশের উন্নয়ন সংগঠক রাশিদা আখতার বলেন, “প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ কেবল ভোগের জন্য নয় — এই টাকায় গ্রামে ঘর তৈরি হয়, কৃষিকাজে বিনিয়োগ হয়, ছেলে-মেয়ে স্কুলে যায়। ট্যাক্স আরোপ করলে এই জীবনচক্রটাই ব্যাহত হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সাবেক উপপরিচালক বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীদের রেমিট্যান্সে কর বসানো হলে বৈধ পথে অর্থ পাঠানোর প্রবণতা কমে যাবে। হুন্ডির মতো অবৈধ চ্যানেল আবার সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে, যা বাংলাদেশে অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ হবে।”
রেমিট্যান্সের উপর কর আরোপ হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো। এসব দেশের বহু পরিবার নির্ভর করে আমেরিকায় দিনরাত শ্রম দেওয়া একজন পরিবারের সদস্যের উপর। ল্যাটিন আমেরিকার অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব মানবিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যকেও নাড়া দিতে পারে বলে উদ্বেগ বাড়ছে বিশেষজ্ঞ মহলে।
ইন্টার-আমেরিকান ডায়ালগের অভিবাসন, রেমিট্যান্স এবং উন্নয়ন প্রোগ্রামের পরিচালক মানুয়েল ওরোজকো বলেন, “রেমিট্যান্স কমানোর যেকোনো উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থে আঘাত হানবে। এর প্রভাব পড়ে নিজ দেশেও।”
তিনি ব্যাখ্যা করেন, অনেক গরিব শহর বা গ্রামে চাকরির সুযোগ সীমিত। সেখানকার মানুষের জন্য রেমিট্যান্সই একমাত্র জীবনরেখা। তাই রেমিট্যান্সের সুযোগ কমলে, মানুষ আবারও ঝুঁকি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে ঢোকার চেষ্টা করবে।
তবে এই করের পক্ষে মতদানকারীরা বলছেন, যারা অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন, তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করা এবং সরকারের জন্য রাজস্ব আয়ের পথ খোলার জন্য রেমিট্যান্সে কর আরোপ কার্যকর হতে পারে।
মার্ক ক্রিকোরিয়ান, যিনি সেন্টার ফর ইমিগ্রেশন স্টাডিজ-এর নির্বাহী পরিচালক, বলেন: “মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে আসে মূলত কাজ করতে এবং সেই টাকা দেশে পাঠাতে। যদি এই কাজটিই কঠিন করে তোলা হয়, তাহলে তাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আসার আকর্ষণ অনেকটাই কমে যাবে।”