বিশ্বের নানা দেশ থেকে এরিত্রিয়া, গুয়াতেমালা, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ঘানা, উজবেকিস্তানসহ অসংখ্য দেশ থেকে মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে আসছেন। তাদের দাবি, তারা ধর্মীয় বিশ্বাস, যৌন পরিচয় অথবা ‘ভুল রাজনীতিবিদদের’ সমর্থনের কারণে নিপীড়নের শিকার। আগের প্রজন্মগুলোর মতো তাদেরও যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরার সুযোগ থাকার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা এখন ভিন্ন।
এক রুশ নির্বাচনকর্মী যিনি ভোট কারচুপির ভিডিও ধারণের দায়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি বলেন, তারা আমাদের কোনো আইসিই কর্মকর্তা দেয়নি, আমাদের কোনো সাক্ষাৎকার নেয়নি। কেউ আমাকে জিজ্ঞাসাও করেনি কী হয়েছিল। তিনি আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন, কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারি স্ত্রী ও শিশুপুত্রসহ কোস্টারিকাতে নির্বাসিত হন।
২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদে শপথ নেওয়ার ঠিক পরপরই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আশ্রয়প্রার্থীদের ব্যবস্থা স্থগিত করেন। তিনি একে ‘যুক্তরাষ্ট্রে আগ্রাসন’ বলে উল্লেখ করে একগুচ্ছ নির্বাহী আদেশ জারি করেন।
আইনজীবী, অধিকারকর্মী ও অভিবাসীদের মতে, এখন আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য যে বাস্তবতা, তা এক বিশৃঙ্খল, নিয়মহীন, পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া—যেখানে কেউ হয়তো অল্প কথায় অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেই এমন দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে যার নামই তারা আগে শোনেননি, আবার কেউ মাসের পর মাস আইসিই হেফাজতে পড়ে আছেন।
সরকার বলছে, তাদের ‘আগ্রাসন’ ঘোষণাটি আদালতের নজরদারির আওতাভুক্ত নয়; একে 'অবিচারযোগ্য রাজনৈতিক প্রশ্ন” বলে দাবি করছে।
তবে আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ)-এর নেতৃত্বে বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠন এই নীতির বিরুদ্ধে ওয়াশিংটন ডিসির ফেডারেল আদালতে মামলা করেছে। তাদের ভাষায়, “এটি যেমন বেআইনি, তেমনি নজিরবিহীন।'
২০২৪ সালের শেষদিকে যখন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তে দৈনিক প্রায় ১০,০০০ অবৈধ অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটত। পরে সেই সংখ্যা কমে আসে, বিশেষ করে ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার পর। তবুও এখনও প্রতিদিন ২০০-র বেশি মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকছেন। তাদের মধ্যে অনেকে আশ্রয়প্রার্থী, তবে সঠিক সংখ্যা স্পষ্ট নয়।
ইমিগ্র্যান্ট ডিফেন্ডারস ল’ সেন্টারের সান ডিয়েগো অফিসের ব্যবস্থাপক আইনজীবী পলিনা রেইয়েস-পেরারিজ বলেন, ২০২৪ সালে বাইডেন আশ্রয়নীতি কঠোর করার পর তারা প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫টি ফোনকল পেতেন। কিন্তু জানুয়ারি ২০-এর পর থেকে সেই সংখ্যা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে।
তার ভাষায়, এখন আইনজীবীরা নিজেরাও জানেন না কীভাবে আশ্রয়ের কেস সামলাতে হবে। “যখন আমরা জানিই না প্রক্রিয়াটা কী, তখন কাউকে কীভাবে পরামর্শ দেব?”
সব নিয়ম মেনে চলেও আশ্রয় মেলেনি
এমন অনিশ্চয়তা আশা করেননি সেই রুশ নাগরিক, যিনি ভবিষ্যতে রাশিয়ায় ফিরে গেলে হয়রানির আশঙ্কায় নিজের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন। ৩৬ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি বললেন, আমরা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছি । আমরা সবকিছু ঠিকঠাক করেছিলাম।
পরিবারটি ২০২৪ সালের মে মাসে মেক্সিকো হয়ে ক্যালিফোর্নিয়া সীমান্তে এসে অপেক্ষা করতে থাকে। সস্তায় এক ঘর ভাড়া নিয়ে প্রায় নয় মাস আশ্রয়ের সাক্ষাৎকারের তারিখের অপেক্ষায় থাকেন তারা। ১৪ জানুয়ারি তারা জানতে পারেন, ২ ফেব্রুয়ারি তাদের সাক্ষাৎকার নির্ধারিত হয়েছে।
কিন্তু ২০ জানুয়ারি, ট্রাম্পের শপথের ঠিক পরপরই সেই সাক্ষাৎকার বাতিল হয়ে যায়।
সেই দিনই মার্কিন কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন জানায়, আশ্রয়ের সাক্ষাৎকার নির্ধারণের সিস্টেম সম্পূর্ণ মুছে ফেলা হয়েছে, এবং হাজার হাজার সাক্ষাৎকার বাতিল করা হয়েছে।
এর বিরুদ্ধে কোনো আপিলের সুযোগ ছিল না। পরিবারটি এরপর সান ডিয়েগোর সীমান্তে গিয়ে আশ্রয়ের আবেদন জানায় এবং সেখান থেকে তাদের আটক করা হয়।
কয়েক সপ্তাহ পর, তাদের হাতকড়া ও পায়ের বেড়ি পরিয়ে কোস্টারিকায় পাঠানো হয়। কেবল শিশুরা ছিল মুক্ত।
ডিপোর্টির সেতু বানানো হচ্ছে মধ্য আমেরিকার দেশগুলোকে
ট্রাম্প প্রশাসন দ্রুত নির্বাসন কার্যকর করতে কোস্টারিকা ও পানামার মতো দেশগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করে—এইসব দেশে ডিপোর্টিদের সাময়িকভাবে রাখা হচ্ছে, যতোদিন না তারা নিজ দেশে বা তৃতীয় কোনো দেশে ফেরত পাঠানো যায়।
এ বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ২০০ জন কোস্টারিকায় এবং ৩০০ জন পানামায় নির্বাসিত হয়েছেন। কঠোর অভিবাসন নীতির পক্ষে যারা, তাদের মতে আশ্রয়ের ব্যবস্থায় বহু মানুষ ভুয়া অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিচারকরা আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদন এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক পর্যন্ত মঞ্জুর করেছেন। অনেক প্রবেশাধিকারবাদী রাজনীতিকরাও বলছেন, আশ্রয়ের ব্যবস্থার অপব্যবহার বেড়েছে।
প্রাক্তন ডেমোক্রেট কংগ্রেসম্যান বার্নি ফ্রাঙ্ক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে এক কলামে লিখেছেন, “বিশ্বজুড়ে মানুষ বুঝে গেছে যে আশ্রয়ের আবেদন করে তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যেতে পারে।”
অজানা ভবিষ্যৎ
রুশ পরিবারটি এখনও কোস্টারিকার ডিটেনশন সেন্টারেই আছে। অনেকেই সেখান থেকে অন্য কোথাও চলে গেছে, কিন্তু তারা রয়ে গেছে। তিনি নিজ দেশে ফিরতে ভয় পান—আর কোথাও যাওয়ারও জায়গা নেই। দুজন মিলে ছেলেকে রুশ ও ইংরেজি শেখান। মাঝে মধ্যে ভলিবল খেলাও আয়োজন করেন, সময় কাটানোর জন্য।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ক্ষুব্ধ নন। তিনি বোঝেন প্রশাসন অবৈধ অভিবাসন রুখতে চায়। তবে বলেন, তিনি সত্যিই বিপদের মধ্যে ছিলেন এবং সব নিয়ম মেনেই আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন।
তার কথায়, 'আমি আমার পরিবারকে ব্যর্থ করেছি। প্রতিদিন আমার মনে হয়—আমি ওদের ব্যর্থ করেছি।'