মো. কামরুজ্জামান কামরুল
রাজনীতি হলো সংগ্রাম এবং আপোসের কলাকৌশল। রাজনীতি কখনো একমুখী সরল রেখায় চলে না। রাজনীতির মাঠে কখনো হাঁটতে হয়, কখনো দৌড়াতে হয়, আবার কখনো থামতে হয়। কখনো কখনো পিছিয়েও আসতে হয়। এটাই প্রচলিত নিয়ম। এই নিয়মের ব্যত্যয় হলেই হয় পা পিছলে পড়তে হয়, নইলে হারিয়ে যেতে হয় চিরতরে রাজনীতির মাঠ থেকে। পা পিছলে পড়া বা হারিয়ে যাওয়ার উদাহরণ এদেশে বহু রয়েছে।
জন আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের একটি ঘোষিত কর্মসুচি থাকে। সে কর্মসুচির প্রতি জনগণের সমর্থন থাকলে, ভোটে নির্বাচিত হয়ে সেই দল রাষ্ট্রক্ষমতায় যেয়ে পুর্বঘোষিত কর্মসুচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনকল্যাণ সাধন করবে – এটাই গনতান্ত্রিক রাজনীতির সাধারণ নিয়ম। এই কাজটি করতে গিয়ে তাদের নানান কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। আর এই কৌশল করতে গিয়ে মাঝে মাঝেই রাজনৈতিক দলগুলো হোঁচট খায়, মুখ থুবড়ে পড়ে, জনবিচ্ছিন্ন হয়। নিজেরাতো বিপদে পড়েই, দেশেরও সর্বনাশ ডেকে আনে।
শুরু করেছিলাম রাজনীতির কৌশল দিয়ে। সমস্যার একটি বড় অংশ মূলত এখানেই নিহিত রয়েছে। আমাদের রাজনীতিবিদরা কৌশলের নামে অনেক সময় অসত্যের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। অসত্য বললে কম বলা হয়। মাঝে মাঝে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। শেখ হাসিনার ক্ষমতার কালে পুলিশ বিএনপি কর্মিদের নামে হাজার হাজার মামলা দায়ের করতো। বাস্তবে কোন ঘটনাই ঘটেনি, অথচ পুলিশ কয়েকশো জনের নামে মামলা দিয়ে দিত। এসব মামলার নামকরন হয়েছিল ‘গায়েবি মামলা’। পুলিশ দিয়ে মিথ্যা মামলা, গুম, ক্রসফায়ারের নামে বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করে আতংকের জনপদ বানিয়ে দেশ শাসন করেছেন শেখ হাসিনা। এটা ছিল তার কৌশল(!)।
বর্তমান অন্তর্বর্তি সরকারও একই পথে হাঁটছে। ‘তৌহিদী জনতা’, ‘ছাত্র-জনতা’ ইত্যাদি নামে মব সন্ত্রাস ঘটিয়ে তারাও সমাজে আতংক তৈরি করেছে। ইতিহাসের পাঠ বলে, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর বাংলায় আরাকানি মগ এবং পর্তুগিজ জলদস্যুরা বারবার হামলা করে হত্যা-খুন-লুটতরাজ করতো। তাদের অত্যাচার এতোটাই অপ্রতিরোধ্য ও বেপরোয়া ছিল যে, তখন এ অঞ্চলকে ‘মগের মুল্লুক’ বলে অভিহিত করা হতো। ২০২৪-এর ৫ আগষ্টের পর তৌহিদী জনতার নামে শুরু হয়েছে গনপিটুনি, খুন-খারাবি, ভাংচুর, বুলডোজারের তান্ডব। এর নামকরন করা হয়েছে ‘মব ভায়োলেন্স’। এখানে প্রশাসন নীরব। সাধারণ জনগণ আতংকিত। মনে হচ্ছে, কয়েকশ বছর পর আবার এই অঞ্চল মগের মুল্লুকের বদলে ‘মবের মুল্লুক’-এ পরিনত হয়েছে। গণহারে হত্যা মামলা দায়ের করে বিরোধী মত দমনের চেষ্টা চলছে। এমন অপকৌশল কখনোই শুভ ফল বয়ে আনে না।
গনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে যে কোন সরকার নার্ভাস হয়ে পড়ে। ছায়া দেখলে ভূত মনে করে আঁতকে উঠে আক্রমন করে বসে। স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি কয়েকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সব সরকারকেই এক পর্যায়ে গনবিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কৌশলের নামে মিথ্যার আশ্রয় নিতে দেখা গেছে।
সরকার স্বৈরাচার হয়ে গেলে গনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমাতাসীন হয়েছিল। তারপর আজীবন ক্ষমতায় থাকার অভিলাষ তৈরি হয় তাদের। এমন অভিলাষ দোষের কিছু নয়। সেক্ষেত্রে সমআদর্শের মানুষগুলোকে একসাথে রেখে সমগ্র জনগোষ্ঠিকে আস্থায় নিয়ে দল ও সরকার পরিচালনা করা দরকার ছিল। তা না করে, পাহাড়প্রমান দূর্নীতির মাধ্যমে দেশব্যাপি একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী তৈরী করে, কিছু আদর্শহীন অরাজনৈতিক মোসাহেবকে দলীয় নেতার নামে গডফাদার বানিয়ে আজীবন রাষ্ট্রক্ষমতা নিজের এবং নিজ পরিবারের হাতে রাখার চেষ্টা করেছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের দলীয় নীতি-আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে মৌলবাদের সাথে আপোষ করেছেন, রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে মন্ত্রী করেছেন, নিজে কওমী জননী হয়েছেন, মদিনা সনদের ভিত্তিতে দেশ চালানোর ঘোষনা দিয়েছেন। এগুলো কি রাজনৈতিক কৌশল, না জাতির সঙ্গে প্রতারণা। এ কথা ঠিক যে, শেখ হাসিনার রেজিমে দেশের কিছু উন্নয়ন হয়েছে, যা বাংলাদেশে নজিরবিহীন। এজন্য তিনি বলার চেষ্টা করতেন, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রাখতে হলে ক্ষমতার ধারাবাহিকতা রাখতে হবে। তিনি উন্নয়নকে গনতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড় করাতেন। প্রসঙ্গত বলতে হয়, ক্ষমতাসীন সরকারের দায়িত্বই হলো দেশের উন্নয়ন করা। সে জন্যই জনগণ তাদের নির্বাচিত করে। সুতরাং উন্নয়নের জন্য কোন পুরস্কার ক্ষমতাসীনরা আশা করতে পারেন না। বরঞ্চ উন্নয়ন করতে না পারলে তাদের জন্য অপেক্ষা করে তিরস্কার। জনগণের করের টাকায় হয় এই উন্নয়ন। কোন দল বা দলের নেতার পকেটের টাকায় দেশের উন্নয়ন হয় না। গণতন্ত্র ও উন্নয়ন সবসময় হাত ধরাধরি করে চলে। উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে সেটাই দেখা যায়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি প্রচলিত কৌশল হলো, ‘শত্রুর শত্রু, আমার মিত্র’। তথাকথিত এই কৌশল চর্চা করতে গিয়ে অনেক প্রগতিশীল নামধারী দলকেও দেখা গেছে চরম প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর সঙ্গে আঁতাত করতে। মুক্তিযুদ্ধের কোন কোন বীর সেনানীকেও কুখ্যাত রাজাকারদের সঙ্গে হাত মেলাতে দেখা যায়। এটা হলো চরম সুবাধাবাদি এবং আদর্শহীন এক অপকৌশল। এই অপকৌশলের চোরাগলি দিয়ে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত মানবতাবিরোধী শক্তি এখন রাজনীতির মাঠে দাপট দেখাচ্ছে। আরেকটি প্রচলিত প্রবাদ, ‘যুদ্ধে এবং প্রেমে কোন কিছুই অন্যায় নয়’। নীতিহীন রাজনীতি চর্চা করতে গিয়ে অনেকেই এই প্রবাদকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। রাজনীতিবিদদের এসব অপকৌশল চর্চার কারণে ভুগতে হয় দেশকে তথা জনগনকে।
এই আলোচনা শেষ হবার নয়। যে কথাগুলো বললাম, তা সকলেই জানেন। আমি শুধু আরেকবার মনে পাড়িয়ে দিলাম। দেশের উন্নয়ন করতে না পারলে মানুষ বাঁচবে না। আর মানুষ বাঁচাতে হলে নীতিহীন অপকৌশল চর্চা থেকে বেরিয়ে রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ করার পথ সন্ধান করতে হবে। রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক আদর্শের উপর দাঁড় করিয়ে, গণতন্ত্রের শত্রুকে পরাজিত করতে হবে। বিভিন্ন সময়ে গণতন্ত্রের শত্রু বিভিন্ন রুপে এসে হাজির হয়। এতদিন পরিবারতন্ত্র আর রাজনৈতিক অলিগার্ক গণতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করে এসেছে। এখন চ্যালেঞ্জ করছে সাম্প্রদায়িক শক্তি। অস্বস্তির ব্যাপার হলো, অন্তর্বর্তি সরকার পশ্চাদপদ চিন্তাধারার এই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে বলে জনমনে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। মুখে গণতন্ত্র ও সংস্কার, আর কাজে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়াকে সাধারণ মানুষ ভাল চোখে দেখছে না। এভাবে চললে এটাকেও অপকৌশল হিসেবে মনে করবে মানুষ।
গনতন্ত্রহীন এই দেশে জনগণ একাধিকবার আন্দোলনে বিজয়ী হয়েছে। কিন্তু বিজয়ের ফল ভোগ করেছে আন্দলনের নেতৃত্বে থাকা দলগুলো। এটা বুঝে সাধারণ মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত ছিল। এবারের আন্দোলনে কোন দলীয় ব্যানার ছিল না বলে তারা হতাশা ঝেড়ে ফেলে আবার মাঠে নেমেছিল। তৈরি হয়েছিল জনবিস্ফোরন। বিজয়ী মানুষের ধারণা ছিল, এবার রাষ্ট্র পরিচালিত হবে জনগণের কল্যাণে। কিন্তু অতীতের মতো এবারও সুকৌশলে গনঅভ্যুত্থানের মালিকানা সাধারণ মানুষের হাতছাড়া হয়ে গেল। নতুন মালিকরা দেশকে কোথায় নিয়ে গিয়ে থামবে, তা শুধু ভবিষ্যতই বলতে পারে।
সমাজে বিভেদ বাড়ছে ক্রমাগত। দূর্নীতি কমছে না। দুর্নীতিপরায়ণের তালিকায় নতুন মুখের সন্ধান মিলছে। অবাধ দূর্নীতির সুযোগ করে দিয়ে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী তৈরি করে দলকে শক্তিশালী করা যায়। কিন্তু জনগণের আস্থা অর্জন করা যায় না। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি পারেনি। পুনরায় এই অপকৌশলের আশ্রয় কেউ নিতে চাইলে সেও ব্যর্থ হবে। এটা ইতিহাসের শিক্ষা। যদিও এদেশের রাজনীতিতে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেওয়া।
রাজনীতি করতে হলে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া শিখতে হবে। দেশটা কোন দলের সম্পত্তি নয়। কোন ব্যক্তি বা পরিবারের সম্পত্তিও নয়। এদেশ আওয়ামী লীগের নয়, বিএনপির নয়, নবগঠিত কোন দলের নয়। ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, আমেরিকা, চীনেরও নয়। বাংলাদেশ হলো ১৭ কোটি বাংলাদেশীর। কৌশলের নামে প্রতারণা করে, বুদ্ধিবৃত্তির নামে ষড়যন্ত্র করে, ধর্মের নামে মিথ্যা বয়ান দিয়ে, সুশিলতার নামে গভীর ফন্দি করে এদেশের আম-জনতাকে ঠকানো এখন কঠিন। একই ইতিহাস বারবার ফিরে আসে না।
রাজনীতিবিদদের এখন উচিৎ, অতীতকে পিছে ফেলে সৃষ্ট সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়া। কাজটি খুব কঠিন না। শুধু প্রয়োজন, ছোট ছোট স্বার্থগুলোকে ত্যাগ করে দিগন্তের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করা।
লেখক : মানবাধিকার কর্মী এবং সাবেক ছাত্রনেতা