১৫ মে, ১৯৭১। ঠাকুরগাঁও শহর থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তরে ঠাকুরগাঁও সদরের ৩ নং আকচা ইউনিয়নের ফাড়াবাড়ি হাটের দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে মাহালীয়া পাড়ায় সংঘটিত হয় এক নির্মম গণহত্যা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ফাড়াবাড়ি হাটের অধিকাংশ পরিবারই ভারতে চলে যান এবং তারা ভারতে গিয়ে ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়।
অধিকাংশ মানুষ ভারত চলে গেলেও স্থানীয় কিছু হিন্দু পরিবার গ্রামে ছিল। তারা চলে যাওয়ার পর ঠাকুরগাঁও-এর গোধুলী বাজারের (স্বর্ণকার পাড়া) কিছু মুসলমান লোকজন আশ্রয় নিয়েছিল তাদের বাড়ি-ঘরে। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল ঠাকুরগাঁও সদরের ক্ষুদ্র কাপড় ব্যবসায়ী। স্বর্ণকার পাড়ার সাথে থানা অবস্থিত। তাই গুজব উঠেছিল যে বাঙালি পুলিশরা সবাই গিয়ে ফাড়াবাড়ি হাটে আস্তানা গেড়েছে।
ঠাকুরগাঁও শহরের সিরাজদ্দৌলা রোডের বাসিন্দা এবং ঠাকুরগাঁও চৌরাস্তার রেডিমেড কাপড় বিক্রয়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সহর আলী তার পরিবার ও তার ছোট ভাইয়ের পরিবার নিয়ে ফাড়াবাড়ি হাটে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সহর আলী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একজন একনিষ্ঠ সমর্থক। ই.পি.আর.জোয়ানসহ মুক্তিবাহিনী যখন পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে ডিফেন্স নিয়ে সামনে এগিয়েছিলেন তখন ঠাকুরগাঁও শহরের যে দুটি লঙ্গর খানা থেকে খাবার সরবরাহ করা হত তার একটি ছিল বর্তমান ঠাকুরগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে। সহর আলী এই লঙ্গর খানায় আর্থিক ভাবে সাহায্যের পাশাপাশি নিরলস ভাবে কাজ করতেন।
সহর আলীর বড় ছেলে মহিউদ্দীন খোকা ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি জয় বাংলা বাহিনীতে রাইফেল ট্রেনিং ও নিয়েছিলেন। এসব কারণে পূর্ব থেকেই স্থানীয় রাজাকারদের সহর আলীর পরিবারের উপর আক্রোশ ছিল। ঠাকুরগাঁও শহর ছেড়ে ফাড়াবাড়ি হাটে আশ্রয় নিলেও স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনা বাহিনী সহর আলী ও তার পরিবারের কথা জানতে পারে।
দিনটি ছিল ১৫ মে। সকাল ১১/১২ টার দিকে লরী ভর্তি পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহচর এদেশীয় রাজাকারেরা প্রবেশ করে ফাড়াবাড়ি হাটে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের গাড়ি টাঙ্গন নদীর পাড়ে রেখে গ্রামে ঢুকে পড়ে। ২৫/৩০ জন পাকিস্তানি আর্মির সাথে ছিল স্থানীয় রাজাকাররা। ফাড়াবাড়ি হাটে প্রবেশ করেই তারা ফাড়াবাড়ি হাটের আশেপাশে সমস্ত বাড়ি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। এমন কি মানুষের গোয়াল ঘরেও আগুন লাগিয়ে দেয়। বাড়ি ঘর লুটপাট করে। আনুমানিক ৩.০০ টার দিকে শশধরের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া সহর আলীকে খুঁজতে পাকিস্তানি বাহিনী আসে।
সহর আলী পূর্বেই জানতে পেরেছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর ফাড়াবাড়ি হাটে আক্রমণের কথা। তাই তিনি তাঁর সন্তানদের বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে বলেন। তিনি ও তাঁর ভাই বহর আলী বাড়ির মহিলাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বাসায় ছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনী বাড়ি ঘেরাও করে সহর আলীকে ডাক দেওয়ায় সহর আলী বের হয়ে আসেন।
সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানিরা তাকে ধরে নিয়ে যেতে উদ্যেত হলে সহর আলীর ছোট ভাই বহর আলী দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। পাকিস্তানিরা দুই ভাইকেই ধরে নিয়ে যায়। আশেপাশের বাড়ি থেকে ধরে আনা সকল পুরুষ মানুষদের শশধরের বাড়ির কুয়োর পাশে নিয়ে জড়ো করে। এদের সাথে ধরে আনা আরও ৮ জন অতি বৃদ্ধ ব্যক্তিকে পাকিস্তানি হানাদাররা ছেড়ে দেয়। আসরের ওয়াক্ত হয়ে যাওয়ায় সমির উদ্দিন নামে একজন নামাজ পড়ার জন্য একটু সময় চাইলে পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনী তাকে সময় দেয়।
নামাজ পড়া হলে সমির উদ্দিনকে পাকিস্তানি বাহিনী কুয়োর পাশে বসতে বলে। ধরে আনা ব্যাক্তিদের হাত বেঁধে কুয়োর পাশে দাড় করিয়ে রাখা হয়। তার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অধিনায়ক তাদের জানায়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার কারণে তাদের মৃত্যুদন্ড দেয়া হল। ৩৪/৩৫ জনকে একসাথে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে পাকিস্তানি নরপিশাচরা।
লাশ কুয়োয় ফেলা হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লাশগুলো ঠিকঠাক করার জন্য সবরাতুলকে কুয়োর মধ্যে নামতে বলে। কুয়োয় নামার সাথে সাথে সবরাতুলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেই সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা মৃত দেহগুলোর প্রতি কটাক্ষ করে বলতে থাকে- ‘এখন তোরা কুয়োর পানি পান কর।’
আশেপাশে থেকে কিছু গাছের ডাল, লতা-পাতা ও সামান্য মাটি দিয়ে চাপা দেয় স্থানীয় রাজাকাররা। পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দোসররা চিৎকার করে গ্রাম বাসিদের নির্দেশ দেয় যে, এসব মৃতদেহ কেউ যদি উঠিয়ে দাফন করার চেষ্টা করে তাহলে তাদেরকেও হত্যা করা হবে। তারা আরো বলে, মৃত মানুষগুলো পাকিস্তান ও ইসলামের শত্রæ, তাই তাদের দাফন পাওয়ার হক নাই।
সেদিন পাকিস্তানি সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর অধিকাংশ পরিবারই আর ফাড়াবাড়ি হাটে থাকা নিরাপদ মনে করেনি। সেদিন রাতেই অধিকাংশ পরিবার তাদের সকল সদস্য নিয়ে মরিচ পাড়া সীমান্ত দিয়ে ভারতের পাটাগড়া ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। যে কয়েক পরিবার ভারতে যায়নি তারা পরের দিন কুয়োর পাশ থেকে মাটি কেটে কুয়োটি ভরাট করে দেয়। স্বাধীনতার পর বাঁশের একটি হালকা বেড়া দিয়ে কুয়োটি ঘিরে রাখা হয়েছিল।
১৯৮৫ সালে শহিদ সহর আলীর সন্তানরা কবরের আদলে একটি প্রাচীর তুলে দেন।দীর্ঘদিন পরে ২০২১ সালের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ফাড়াবাড়ি হাট গণকবরের উপর একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করে। স্মৃতিস্তম্ভের ফলকে লেখা আছে ‘ বীর মুক্তিযোদ্ধা সমাধি’। নাম শহিদ মুক্তিযোদ্ধা সাইফুদ্দিন। স্মৃতিস্তম্ভে কোথাও উল্লেখ নেই ফাড়াবাড়ি হাট গণহত্যায় শহিদ হওয়া ব্যক্তিদের গণকবর এটি কিংবা গণহত্যার বর্ণনা । এভাবে ইতিহাস বিকৃতকরণ চলতে থাকলে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মে কাছে মুক্তিযুদ্ধ শুধু কল্পকাহিনী হিসেবে বিবেচিত হবে।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়