নির্বাচন এলেই নতুন রাজনৈতিক দল গঠন, দল বদল বা জোট গঠনের ইতিহাস বেশ পুরোনো। সময়ের সাথে সাথে প্রতিনিয়তই নানা বিষয় নিয়ে রাজনীতিবিদদের মাঝে রাজনৈতিক মতপার্থক্য তৈরি হয়। তখন কেউ হয়তো দল ছেড়ে অন্য দলে যোগ দেয়। কেউবা নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন। সাধারণত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনীতির মাঠে নতুন দল গঠনের হিড়িক পড়ে। তবে ৫ আগস্টের পর এবার চিত্রটা যেন একেবারেই ভিন্ন। এরই মধ্যে গেল ৮ মাসে অন্তত ৩৫টি নতুন দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। আর ২০ মার্চ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জারি করা গণবিজ্ঞপ্তির পর ইতিমধ্যে ৭০টির মতো নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের আবেদন করেছে। যা রীতিমত বিস্ময়কর।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এত অল্প সময়ের মধ্যে গণহারে দল গঠনের প্রবণতার উদ্দেশ্য ভালো নয়। নতুন যে দলগুলো হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে হয়তো আরও হবে তাদের আদর্শিক ভিত্তি, সমর্থন এবং টিকে থাকার ক্ষমতা অধিকাংশের নাই। তবে এসব দল মানুষের ভাবনার জগতে বিশেষ কোন আবেদন সৃষ্টিও করতে পারছেন না, পারার সম্ভাবনাও নাই। হয়তো নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য করাই উদ্দেশ্যে এই দলগুলো গঠন করা হচ্ছে।
গত নয় মাসে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা অধিকাংশ রাজনৈতিক দলেরই নেই কোন কার্যকরী কমিটি, দলের জেলা উপজেলা কার্যালয় তো দূরের কথা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও নাই। অস্তিতহীন সব ঠিকানা ব্যবহার করে কাগজে বাঘের মতো এসব দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করার সময় সারাদেশে তাদের কমিটি ও কার্যালয় আছে বলে জানিয়েছে । কিন্তু বাস্তবতা হলো কার্যালয় তো দূরে থাক, সাইনবোর্ড পর্যন্ত নাই।
ইসিতে আবেদন জমা পড়া কেবলই নামসর্বস্ব এসব দলের নামও অনেকটা অদ্ভুত, অচেনা ও চমকপ্রদ। যেমন বাংলাদেশ বেকার সমাজ, বাংলাদেশ সংসারবন্দি পার্টি, বাংলাদেশ প্রবাসী কল্যাণময় পার্টি, বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ, আ-আম জনতা পার্টি, জনতা পার্টি বাংলাদেশ, সমতা পার্টি, সার্বভৌমত্ব আন্দোলন। এমনকি ‘ইউক্লিয়াস পার্টি’ নামেও আবেদন পড়েছে ইসিতে।
ইসিতে নিবন্ধনের আবেদন করা রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বলেন, দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় অনেকেই রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দিয়ে নিজের পরিচিতি তৈরি করতে চায়। যাতে ব্যক্তিগত প্রভাব বিস্তার থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক সুবিধা আদায় করতে পারে। পদপদবী ব্যবহার করে তৎবির বাণিজ্য করাও হয়তো অনেকের লক্ষ্য হতে পারে। গণতান্ত্রিক চর্চার চেয়ে নানা হিসাব-নিকাশের সমীকরণই মুখ্য বলে আমার মনে হয়।
বৈচিত্র্যময় পন্থায় নতুন রাজনৈতিক দলের যাত্রা শুরু হয়েছে। দেখা গেছে কেউ সংবাদ সম্মেলন ডেকে নিজেদের যাত্রা ঘোষণা করছে, কেউবা ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে বা ওয়েবসাইটে আত্মপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। আবার অনেক দল নিবন্ধনের আবেদনই একমাত্র কাজ হিসেবে সারছে। তাদের মাঠে তেমন কোনো তৎপরতা নেই, নেই সংগঠনের কাঠামো, কর্মসূচি বা জনসম্পৃক্ততা।
নিজের পরিচিতি বাড়ানো ও গণমাধ্যমে নিজের অবস্থান তৈরির জন্যই যে দলগুলো হচ্ছে তা তাদের নাম ও কর্মকান্ড দেখলেই বুঝা যাচ্ছে।
যদিও নতুন দলের নেতাদের বক্তব্য তারা রাজনীতিতে এসেছেন জনসেবার তাগিদে, দেশ ও জনগণের সেবা করাই একমাত্র উদ্দেশ্য।
হঠাৎ কেন রাজনৈতিক দল গঠন করলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টির (বিপিপি) আহ্বায়ক মো. সিরাজুল ইসলাম ভোরের ডাককে বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করি না। দেশের মানুষের পাশে থাকতে এবং তাদের খেদমত করতেই দল গঠন করেছি।
ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি নামক দলের আহ্বায়ক পরিচয় দেয়া হাফেজ মাওলানা মাহমুদ আব্বাস বলেন, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সবার অধিকার নিশ্চিত করা, চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি ও বেকারত্ব দূর করতে আমরা দল গঠন করেছি।
দুনীতির দায়ে সাজাভোগ করা বহুল আলোচিত ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমিনও সম্প্রতি কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ‘আ-আম জনতা পার্টি’ নামের একটি দল গঠন করেছেন। হঠাৎ কেন রাজনীতিতে এমন প্রশ্নে আ-আম জনতা পার্টির চেয়ারম্যান রফিকুল আমিন বলেন, এখন শুধু ব্যবসা করে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। রাজনীতিতে জড়িত থাকলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সরাসরি কাজ করার সুযোগ থাকে। দেশকে উন্নয়নের পথে নিতে হলে সেই ভূমিকা জরুরি। দেশের জন্য কাজ করতে চাইলে রাজনীতিই সবচেয়ে কার্যকর প্ল্যাটফর্ম বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি দাবি করেন, বেকারত্ব দূরীকরণের ক্ষেত্র তৈরি করতেই রাজনীতির ময়দানে তার পদচারণা। তিনি বলেন, আমি মনে করি রাজনীতিতে সরাসরি সম্পৃক্ত না হলে দেশের জন্য ও দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করার সুযোগ খুব কম।
তিনি আরও বলেন, শুধু একটা ব্যবসা সেক্টর নিয়ে এক জাগায় বসে থাকলাম এবং ব্যবসা দিয়ে দেশের উন্নতি করে ফেললাম এ ব্যপারটা খুব লিমিটেশন। যখন রাজনীতিতে জড়িত হবো তখন আসার এ কাজ করার সুযোগ আরও বেড়ে যাবে। আমি আরও দেশেল উন্নয়নে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে পারবো।
চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ও বিএনপি থেকে বহিস্কৃত সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদের নেতৃত্বে কিছুদিন আগে অভিষেক হওয়া নতুন রাজনৈতিক দল জনতা পার্টি বাংলাদেশ। এ দলের মহাসচিব শওকত মাহমুদ বলেন, আমরা কিংস পার্টি নই, কুইন্স পার্টি নই। আমরা নিজের শক্তিতে নির্বাচনে দাঁড়াতে চাই। আমাদের পেছনে এমন কোন ব্যাকিং নেই, যে ব্যাকিংয়ের কারণে আমরা আকস্মিকভাবে নেমে পড়েছি আগামী নির্বাচনে আমাদের একটা কিছু করতেই হবে। আমরা আমাদের নিজেদের শক্তিতেই নির্বাচন করতে যাচ্ছি।
তবে সাধারণ মানুষ আশা করে, নতুন দলগুলো নিজেরা রাজনৈতিক পরিচিতি বাড়ানো, প্রভাব বিস্তার ও নানা স্বার্থে ব্যবহৃত না হয়ে দেশের মানুষের জন্য কাজ করুক। তাহলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবেন। তা না করে ব্যক্তি স্বার্থ ও প্রভাব বিস্তার নিয়ে ব্যস্ত থাকলে শেষ পর্যন্ত রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে হবে।
