মো. কামরুজ্জামান কামরুল
সম্প্রতি বাংলাদেশে নজিরবিহীন ছাত্র-গনআভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং নব্বুয়ের ছাত্র-গনভ্যুত্থানের চেয়েও তীব্রতর ছিল এই চব্বিশ সালের মধ্য জুলাইয়ের অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানের প্রধান বৈশিষ্ঠ্য হলো কোন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে এটি সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘ দিন থেকে দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি, সীমাহীন দূর্নীতি, ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া – প্রভৃতি কারণে আপামর জনসাধারন যারপর নাই আওয়ামী লীগের হাসিনা সরকারের উপর ক্ষুব্ধ ছিল। এরমধ্যে ছাত্র সমাজের চাকুরীতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে হিংস্রভাবে দমন করতে গিয়ে শত শত ছাত্র-জনতাকে হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্র সমাজের নেতৃত্বে অভূতপুর্ব ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ঘটে যায়। প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। এটা হলো ঘটে যাওয়া ছাত্র-গনঅভ্যুত্থানের অতি সহজ-সরল বয়ান। কিন্তু অভ্যন্তরে থাকতে পারে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ভূমিকা এবং মহলবিশেষের ‘অতিসতর্ক কলাকৌশল’।
অভ্যন্তরে যা-ই ঘটুক না কেন, প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রাম-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী জনগণের কিছু আকাঙ্ক্ষা থাকে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এবং নব্বুই ও চব্বিশের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানেও সাধারণ মানুষ কিছু আকাঙ্ক্ষাকে বুকে ধারণ করেই রাজপথে নেমেছিল। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং নব্বুইয়ের গণঅভ্যুত্থানের ফল যেমন সাধারণ মানুষ ভোগ করতে পারেনি; এবারও এই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের ফসল ছিনতাই হতে চলেছে বলে মানুষের মনে তীব্র সন্দেহ রয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার তিপান্ন বছর অতিক্রান্ত প্রায়। কিন্তু স্বাধীনতার মূল চেতনা অর্থাৎ জনগনের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং একটি প্রকৃত উদার, অসাম্রদায়িক গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অর্থনৈতিক মুক্তি বলতে আমরা বুঝি জনগনের মৌলিক অধিকারসমূহের বাস্তবায়ন এবং অর্থনৈতিক সাম্য অর্থাৎ শোষনমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা; গনতন্ত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা। গনতন্ত্র ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষে এ দেশের জনগনের সুদীর্ঘকালের সংগ্রামের ঐতিহ্য রয়েছে। স্বাধীনতাপুর্ব তেইশ বছরের সংগ্রাম, স্বাধীনতা-উত্তর স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম এবং নব্বুই ও চব্বিশের গনঅভ্যুত্থান - এ সবকিছুই পরিচালিত হয়েছে জনগনের অর্থনৈতিক মুক্তি ও গনতন্ত্রের জন্য। তবে দুঃখজনকভাবে লক্ষ্যনীয়, রাজনৈতিক দলগুলো এখন জনদাবি বাস্তবায়নে উদাসীন। নব্বইপরবর্তী গনতন্ত্র ‘পুনরুদ্ধারের’ সময় থেকে অদ্যাবধি জনগনের অধিকার নিয়ে তারা সংগ্রাম করে না। এখনকার সংগ্রাম ক্ষমতায় যাওয়া অথবা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। দেশের জনগনের ভাগ্য নিয়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, সরকার বা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক মহল তেমন ভাবিত নয়। সাধারণ মানুষ এগুলো বোঝে এবং এজন্য তারা হতাশ। দীর্ঘ সময় পর অদলীয় সাধারণ ছাত্রসমাজ জেগে উঠায় হতাশ জনতা আবার আশার আলোয় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু অতিতের মতো পুনরায় হতাশার মেঘ ক্রমেই ছেয়ে ফেলছে সমস্ত আকাশ।
স্বাধীনতার চেতনা প্রতিফলনে বড় ব্যর্থতা সাম্যভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা, সম্পদের সুষম বন্টন এবং ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারা। তবে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে জনগনের মৌলিক অধিকারসমূহের বাস্তবায়নের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে সকল প্রকার অর্থনৈতিক শোষন থেকে মেহনতি মানুষের মুক্তির কথা; ১৫ অনুচ্ছেদে সব মানুষের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, চিকিৎসা, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার; ১৬ অনুচ্ছেদে শহর ও গ্রামের বৈষম্য দূরীকরনে গ্রামাঞ্চলের আমূল রুপান্তর; ১৯ অনুচ্ছেদে মানুষে মানুষে অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ এবং সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। সেবামুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ২১ অনুচ্ছেদে বলা হয় ‘সকল সময়ে জনগনের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সংবিধানের এসকল বিধানসমূহ সর্বদাই উপেক্ষিত। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য, শিক্ষা, চিকিৎসা সাধারন মানুষের নাগালের মধ্যে নেই। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও কর্তব্য ভূলে গিয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক মহল শিক্ষা ও চিকিৎসার মত অতি গুরুত্বপুর্ন ও মানবিক বিষয়কে একশ্রেণীর নব্য পুঁজিপতির মুনাফা বানানোর যন্ত্রে পরিনত করতে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে চলেছেন। যে কারনে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত।
স্বাধীনতার আরেকটি অণ্যতম লক্ষ্য প্রকৃত উদার গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা; যা জবাবদিহিমূলক এবং সকল নাগরিকের আইনী, মানবিক ও মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করতে সক্ষম। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রতিটি সংগ্রামই গনতন্ত্রের আকাংখায় পরিচালিত হয়েছিল। জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশ চালাবেন; সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহিতার মধ্যে এনে জনগনের অধিকার, স্বার্থ ও কল্যাণ তাতে নিশ্চিত হবে - এটাই ছিল সেই গনতান্ত্রিক সংগ্রামের মূল চেতনা। কিন্তু আজও তা পূরণ হয়নি। তিপান্ন বছর পরে এখনও সেই সংগ্রাম প্রাসঙ্গিক। গনতন্ত্র বলতে বাংলাদেশের মানুষ কোনো পোষাকী বা আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব গনতন্ত্রকে বোঝে না; বোঝে প্রকৃত ও উদার গনতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে। গনতন্ত্র বলতে অবাধ নির্বাচন, শক্তিশালী-নিরপেক্ষ-স্বচ্ছ নির্বাচন কমিশন, দলীয় প্রভাবমুক্ত স্বাধীন বিচার বিভাগ, গনসম্পৃক্ত সরকার, বিরুদ্ধমতামতের প্রতি সরকারের শ্রদ্ধাবোধ, প্রশাসনের সর্বস্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা দেশ পরিচালনা, নগ্ন দলীয়করন বন্ধ করে দলনিরপেক্ষ যোগ্য-মেধাবী কর্মকর্তা-কর্মচারী দ্বারা প্রশাসন পরিচালনা ইত্যাদি বোঝায়। এক্ষেত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে এই বিষয়গুলো প্রতিফলিত হয়েছে।
দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিকদলগুলোর পরস্পরের প্রতি প্রচন্ড আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস রয়েছে। এর ফলে ক্ষমতায় গেলে তারা ক্ষমতা ছাড়তে চান না। নির্বাচিত সরকারও স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। পারস্পরিক এই আস্থাহীনতার মধ্যেই নিহিত রয়েছে বিদ্যমান সমস্যার মূল উপাদানসমূহ। গনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে শক্তিশালী করে নিরবিচ্ছিন্ন গনতন্ত্র চর্চার মাধ্যমেই কেবলমাত্র এই অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা দুর হওয়া সম্ভব।
একটি হতাশ জাতির ভবিষ্যত অন্ধকারময়। ভয়াবহ অন্ধকারের দিকে ধাবমান জাতিকে আলোর পথে এনে হতাশামুক্ত করতে হবে। চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের ফসল অতীতের মতো আবার যেন বর্গিরা লুটে নিতে না পারে। জনগনের সংগ্রামের ফসল জনগণ ভোগ করবে। আর তা করতে হলে দেশব্যাপী রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। গনমানুষের মনের অনুভুতিকে প্রাধান্য দিয়ে কর্মসূচি প্রনয়ন করাই হবে মূল লক্ষ্য। রাষ্ট্রের কাছ থেকে সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। অপশাসন টিকিয়ে রাখার স্বার্থে শাসক মহল কখনো কখনো সংবিধান লংঘন করে। আবার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কালাকানুন জারি করে যা মানুষের জন্য অকল্যান বয়ে আনে। এ বিষযগুলো সম্পর্কে জনগনকে সচেতন করতে হবে। এ ছাড়াও শিল্পোন্নয়ন ও কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থানের উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষে রপ্তানিমুখী উৎপাদনে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। বাজার দরের সাথে সামঞ্জস্য রেখে শ্রমিকের বেতন নির্ধারন করতে হবে। রাজস্ব প্রদানে জনগনের অংশগ্রহন উৎসাহিত করতে আয়করদাতাকে রাষ্ট্রের সম্মানিত নাগরিকের মর্যাদা প্রদান করতে হবে। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রতিপক্ষ দমনে ব্যবহার না করে জনগনের জানমালের নিরাপত্তাবিধানে নিয়োজিত করতে হবে। প্রতিটি কর্মক্ষম নাগরিককে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ দেশীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় আহরনের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশগামীদের নামমাত্র ইন্টারেস্টে ব্যাংক ঋনের ব্যবস্থা করতে হবে যা উপার্জন থেকে তিনি ব্যাংককে পরিশোধ করবেন। রাষ্ট্রের খরচে জনগনের চিকিৎসা সেবা ও শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোকে এমন সুনির্দিষ্ট জনচাহিদার ভিত্তিতে কর্মসুচি প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নে জনগণের কাছে অঙ্গিকার করতে হবে। এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের উপর শক্তিশালী নাগরিক সমাজকে প্রেসার গ্রুপ হিসেবে সক্রিয় থাকতে হবে। সমাজে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর ধারাবাহিক ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে সামাজিক শক্তি হিসেবে শক্তিশালী নাগরিক সমাজের ভূমিকা অপরিসীম। রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে জনগণ সংগঠিত হবে, আর রাজনৈতিক দল সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে কি না – তা দেখভাল করবে নাগরিক সমাজ। এভাবে জনগণের প্রতিটি অংশকে পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা মানুষের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন এবং প্রকৃত গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আমরা বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা গেলে বাংলাদেশ বিশ্বমানচিত্রে মডেল হিসেবে স্থান করে নিতে সক্ষম হবে।
লেখক : মানবাধিকার কর্মী এবং সাবেক ছাত্রনেতা