গত ৭ এপ্রিল সোমবার সকাল ১১টায় আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের জরুরি ফোনকল পেলাম। তিনি জানালেন প্যালেস্টাইন সলিডারিটির ব্যানারে ‘মার্চ ফর গাজা’ আয়োজনের কথা। মাওলানা শায়খ আহমদ উল্লাহসহ উনারা কয়েকজন বসে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বললেন, তোমাকে হোয়াটস্অ্যাপ মেসেঞ্জার গ্রুপে যুক্ত করা হলো।
এরপর কিছু যোগাযোগ ও দায়িত্বের কথা জানালেন, আমি বিনয়ের সাথে সম্মতি জানালাম। ঝটপট আমরা কয়েকটা গ্রুপ কল করলাম। মাহমুদ ভাই আরও কাকে কাকে যুক্ত করা যায় জানতে চাইলেন। মোটামুটি একটা তালিকা হলো।
অনেকগুলো ফোন নম্বর উনাকে দেয়া হলো। সিদ্ধান্ত হলো সবাই ব্যক্তিগতভাবে ভিডিও বক্তব্য রেকর্ড করে নিজ নিজ আইডি এবং প্যালেস্টাইন সলিডারিটি গ্রুপ থেকে পোস্ট করা হবে। সেদিন সংসদ ভবনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে আমাদের বৈঠক ছিল।
সংসদ ভবনে দাঁড়িয়েই আমরা কয়েকজন ভিডিও বক্তব্য রেকর্ড করলাম। শায়খ আহমদ উল্লাহ সাহেব বিএনপির সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব নিলেন। এনসিপি, জামায়াতে ইসলামী, গণঅধিকার পরিষদসহ অন্যান্য সকলের সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব নিলেন মাহমুদুর রহমান নিজে। আমাকে হেফাজতে ইসলাম ও চরমোনাই পীরের সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব দেয়া হলো।
সংসদ ভবনের মিটিং শেষ করে মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদীসহ কয়েকজন হেফাজতে ইসলাম নেতাকে নিয়ে আমরা সন্ধ্যায় আমার দেশ অফিসে বসলাম। চরমোনাই পীর সাহেব ঢাকার বাইরে একটি অনুষ্ঠানে ব্যস্ত ছিলেন।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন ও নায়েবে আমীর মুফতি ফয়জুল করিম সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে বিকেল নাগাদ মাহমুদুর রহমানের সাথে চরমোনাইর পীর সাহেব হুজুরের সাথে কথা বলানোর ব্যবস্থা হলো।
শায়খ আহমদুল্লাহ’র অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা, শায়খ মিজানুর রহমান আজহারীর সিরিয়াস মনিটরিং এবং মাহমুদ ভাইদের অদম্য সাহস ও দৃঢ়তা অল্প সময়ে বিশাল পরিসর তৈরি করে ফেলে।
মাওলানা আব্দুল হাই সাইফুল্লাহ, শায়খুল হাদীস আল্লামা মামুনুল হক, মুফতি রেজাউল করিম আবরার, রকমারির মাহমুদুল হাসান সোহাগ, এনসিপির বিপ্লবী নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ, তরুণ সংগঠক ফাহিম আব্দুল্লাহ, ধানমন্ডি তাকওয়া মসজিদের খতিব মাওলানা সাইফুল ইসলাম, ছাত্র শিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, ইনকিলাব মঞ্চের ওসমান বিন হাদি, আমার দেশ-এর উপ নির্বাহী সম্পাদক জাহেদ চৌধুরী, তরুণ বক্তা ড. ফায়জুল হক, আপ বাংলাদেশের অন্যতম সংগঠক রাফে সালমান রিফাতসহ অনেকের সীমাহীন আন্তরিক প্রচেষ্টায় একটা বিরাট গতি ও সম্ভাবনা সঞ্চারিত হয়।
শুরু থেকে আমরা সবাই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম, এই আয়োজনকে আমরা রাজনৈতিক রূপ দেয়া থেকে বিরত থাকবো। দলীয় কোনো ডেমোনেস্ট্রেশন থাকবে না। সরকারের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির পক্ষ থেকে বিনিয়োগ সম্মেলনকে সামনে রেখে ‘মার্চ ফর গাজা’ পেছানোর অনুরোধ আসলে আমরা কিছুটা বিচলিত হই। মাহমুদুর রহমানের অনমনীয় দৃঢ়তায় অনুষ্ঠান সংশোধিত করে শাহবাগ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থানান্তর এবং মানিক মিয়া এভিনিউ অভিমুখে পদযাত্রার কর্মসূচি রহিত করা হয়।
ওই দিন ছিল মূলত: দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট। সকালে রাওয়াতে (রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন) এর একটি বড় সেমিনার ছিল। সেখানে মাহমুদুর রহমান একটি তাৎপর্যপূর্ণ পেপার উপস্থাপন করেছেন। তিনিসহ আমাদের বেশ কয়েকজনের সেখানে আমন্ত্রণ ছিল। সেমিনারে কয়েকশত সাবেক সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাসহ বিদগ্ধজনরা উপস্থিত ছিলেন। সম্ভবত: রাওয়ার ইতিহাসে এরকম অনুষ্ঠানের নজির বিরল।
যাই হোক কথা ছিল মার্চ ফর গাজা’র সংগঠকগণ আমরা বেলা ১২ টায় বায়তুল মোকাররমে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড রুমে একত্রিত হবো। সেখান থেকে জোহর নামাজ শেষে সবাই বাংলা একাডেমির অপোজিট গেট দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করবো।
কিন্তু মাহমুদুর রহমানসহ আমরা কয়েকজন রাওয়ার প্রোগ্রামে আটকে গেলাম। বাকীরা প্রায় সকলে বায়তুল মোকাররমে সমবেত হলেন। অন্যদিকে আমাদের দলের নেতা-কর্মীরা জননেতা বিএম নাজমুল হক ও যুবনেতা শাহাদাতুল্লাহ টুটুলের নেতৃত্বে বেলা ১২ টায় এবি পার্টির কেন্দ্রীয় অফিসে সমবেত হয়েছে। ২ টার মধ্যে তাদের সাথে আমার সোহরাওয়ার্দীতে মিলিত হবার কথা; এর কোনোটাই করতে পারলাম না।
রাওয়া থেকে ১ টায় বের হওয়ার কথা থাকলেও বের হতে হতে আমাদের বেলা ২ টা বেজে গেল। আমি শংকিত ছিলাম, রাস্তার যে অবস্থা আদৌ আমরা সময়মত পৌঁছাতে পারবো কিনা। মাহমুদ ভাই, আমি ও গুমের শিকার সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান একসঙ্গে রওয়ানা দিলাম। মহাখালির রাস্তায় বের হয়েই অভাবনীয় দৃশ্য চোখে পড়ল। হাজার হাজার মানুষের স্রোত।
কল্পনাও করতে পারছিনা এতো দুর থেকেও মানুষ পায়ে হেঁটে আসতে পারে! কিছুক্ষণ পর পর পিকআপ ভ্যান, সিএনজি’র দেখা পেলাম- যেখানে ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে নারী, পুরুষ ও কিশোরেরা। বহু কষ্টে জ্যাম ঠেলে ঠেলে আমাদের গাড়ি ফার্মগেট পর্যন্ত আসলো। পথিমধ্যে মাহমুদ ভাই কয়েকবার নেমে হাঁটা শুরু করতে চাইলেন, তাঁকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলাম আমরা দুজন।
কাওরান বাজারের কাছাকাছি আসার পর জনতার স্রোতে আর এগুতে পারলাম না। নেমে হাঁটা শুরু করতে বাধ্য হলাম। মাহমুদ ভাই বিদ্যুৎ গতিতে হাঁটেন, তাঁর সাথে পেরে উঠা কঠিন। মারুফ ভাই মোটা মানুষ তিনি বার বার পিছে পড়ে যাচ্ছিলেন।
হাঁটতে গিয়ে বিপদ হলো পরিচিত লোকজন দেখলেই সালাম ও হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিলো। কেউ কেউ যখন চিনতে পারছিলো তারা সামনে লোকজন সরিয়ে পথ করে দিচ্ছিলো। আমার জীবনে এত জোরে শেষ কবে হেঁটেছি তা মনে করতে পারলাম না। মাঝে মাঝে কয়েকটা মিছিলে ঢুকে মিছিলেও সামিল হয়েছি। কিন্তু আমাদের হাঁটার গতি ছিলো মিছিলের চেয়েও দ্রæততর। হাঁটতে হাঁটতেই নানা রকমের মানুষ চোখে পড়লো, বলা যায় আবালবৃদ্ধবণিতা। হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের স্রোত।
সবার অভিমুখ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে। চলতে চলতেই মাহমুদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম; এত মানুষের সাড়া পাবেন আপনি কি ভেবেছিলেন? তিনিও অবাক বিস্ময়ে বললেন; না কল্পনাও করিনি। লাখো মানুষের ভিড়ে রমনা পার্কের মুখ পর্যন্ত এসে আর এগুনো যাচ্ছিলো না। মানুষের চাপে লেপ্টে যাবার মত অবস্থা। তখন হঠাৎ কিছু তরুণ এসে সামনে পেছন থেকে আমাদের জন্য একটা আড়াল তৈরি করলো। চিৎকার করে পথ করে দেয়ার অনুরোধ জানালো।
এত মানুষের সমাগম আর তীব্র তাপে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে দম বুঝি এখনই বন্ধ হয়ে যাবে। পায়ের লিগামেন্টগুলো তীব্র ব্যথায় অচল হবার অবস্থা। মনের জোরে কোনো মতে ভিড় ঠেলে এগুচ্ছি। মাঝে মাঝে লজ্জাও পাচ্ছিলাম, মাহমুদ ভাই এখনও এত শক্ত! অথচ আমার অবস্থা একেবারেই কাহিল! সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট পর্যন্ত কীভাবে যে এলাম তার হুঁশ নাই। লোকজন এমনভাবে ড্যান্সড হয়ে আছে যে, গেট পুরোই বøকড। একবার ভাবলাম, আর না এখানেই থাকি, ভেতরে যাবার দরকার নাই।
কিন্তু না লোকজন সহযোগিতা করলো। এই বয়সে দেয়াল বেয়ে উঠলো মাহমুদ ভাই, আমিও উঠলাম। মনে হয় যেন ২৫-৩০ বছর আগের সেই ছাত্রাবস্থা ফিরে এসেছে। দেয়াল টপকে মাঠে নামার পর একদল স্বেচ্ছাসেবক আমাদের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তারা যে কীভাবে আমাদের বগল দাবা করে অনেকটা আলগা দিয়ে মঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছালেন তা কল্পনাতীত। যেদিকে চোখ যায় মানুষ আর মানুষ! পত পত করে উড়ছে ফিলিস্তিনের পতাকা।
মঞ্চের সামনে গিয়ে আমরা যখন পৌঁছালাম তখন ঘড়িতে ৩ টা পাঁচ মিনিট। আমার কাছে অবিশ্বাস্য স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিল। মাহমুদ ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন মাওলানা শায়খ আহমাদুল্লাহ। তাঁর দুচোখ অশ্রুসিক্ত। তিনি মাহমুদ ভাইকে বললেন, আপনাকে না দেখে আমরা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। মানুষের চাপে একের পর এক বেরিকেড ভেঙে পড়ছিল। স্বেচ্ছাসেবকদের একেকজনের অবস্থা অবর্ণনীয়, কী যে পরিশ্রম তারা করেছেন তা ভাষায় বর্ণনা করার মত না।
আমরা যখন মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ালাম তখন সাংবাদিকদের জন্য নির্মিত প্ল্যাটফরম ভেঙে পড়লো। লক্ষ মানুষের সমাগমের মধ্যেও অদ্ভুত এক শৃঙ্খলা! কেউ এসে ব্যাজ পরিয়ে দিচ্ছেন, কেউবা হাতে ও গলায় ফিলিস্তিনের পতাকা তুলে দিচ্ছেন। কেউবা স্যালাইন পানি পান করাচ্ছেন। তরুণদের সে কী অসাধারণ তৎপরতা! কিছুক্ষণ পর পর ধ্বনিত হচ্ছিল তকবির ধ্বনি ও স্লোগান ।
এ বিশাল মহা মানব প্লাবনে দাঁড়িয়ে মাহমুদুর রহমান যখন ঘোষণাপত্র পড়ছিলেন সবাই সম্মতিসূচক ধ্বনি প্রতিধ্বনিত করছিল। প্রত্যয়, সংহতি, দাবি ও অঙ্গীকারের সমন্বয়ে এক অবিস্মরণীয় ঘোষণাপত্র পাঠ করা হলো। এরপর বায়তুল মোকাররমের খতীব সবাইকে নিয়ে আবেগরূদ্ধ দোয়া করলেন। মঞ্চ থেকে বার বার অনুরোধ করা হচ্ছিল আমরা যেন একটু অপেক্ষা করি।
জনজোয়ারের ভিড়ে না হয় বের হওয়া খুব কঠিন হবে। যতটুকু আমরা ভেবেছি তার চাইতেও বাস্তবে অনেক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাদের। মঞ্চ থেকে নেমে একটি এম্বুলেন্সে করে আমাদের ৯-১০ জনের গন্তব্যে পৌঁছাতে প্রায় দুই ঘন্টার বেশী সময় লেগেছে। ফেরার সময় আমরা হিসাব মেলাচ্ছিলাম কত হতে পারে এই জনসমাগম? কিছুক্ষণ পর পর আমরা নিজেরাই নিজেদের হিসাব বদলাতে বাধ্য হচ্ছিলাম।
সর্বশেষ অনুমান হলো এটা দশ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে। এই অকল্পনীয় অভাবনীয় সমাবেশ আমাদেরকে নতুন করে আত্মপরিচয় দিয়েছে। দল মতের উর্ধ্বে উঠে ইস্যু ভিত্তিক জনমানুষের এইযে ঐক্য এর বহুমাত্রিক মেসেজ রয়েছে। আশাকরি সবাই নিজ নিজ হিসাব মেলাবেন।
আমার চেনা পরিচিত অনেকেই অনিবার্য ব্যস্ততার কারণে ইচ্ছে থাকা সত্তেও এই সমাগমে উপস্থিত হতে পারেননি। ঢাকার বাইরের আরও কোটি মানুষ সুযোগ থাকলে হয়তো সমবেত হতেন। বাংলাদেশের মানুষের এই সংহতি, ঐক্যবদ্ধতা ও সংগঠিত হওয়ার প্রবণতা নিয়ে চাইলে কেউ গবেষণা করে দেখতে পারেন।
এই রূপান্তরকে ইতিবাচক শক্তিকে পরিণত করতে পারলে ভবিষ্যতে আমরা অবশ্যই নতুন এক বাংলাদেশের সন্ধান পাবো। আমরা যদি আমাদের ঐক্যের জায়গা নির্ধারণ করতে পারি এবং কৃতিত্ব নেয়ার মানসিকতা পরিহার করে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও স্বতঃস্ফূর্ততায় অবগাহন করতে পারি তাহলে অপরূপ এক সভ্যতা আমাদের হাত দিয়ে গড়ে উঠবে কোনো সন্দেহ নেই।
যে দাবি, ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতি সমাবেশে আমরা পাঠ করেছি তা হৃদয়ে ধারণ করা এখন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। হে মহান আল্লাহ সর্বশক্তিমান আপনি আমাদের সহায় হোন। ফিলিস্তিনের মজলুমদের রক্ষা করুন। চুড়ান্তভাবে ধ্বংস হবার আগে আমাদের উপলব্ধিকে শাণিত করুন- আমীন।
লেখক : চেয়ারম্যান, আমার বাংলাদেশ পার্টি