চৈত্রের দুপুরের তপ্ত রোদকে উপেক্ষা করে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি বর্বর হামলা ও গণহত্যার প্রতিবাদ জানাতে ঢাকার বুকে ইতিহাস সৃষ্টি করে বিক্ষুদ্ধ জনতার স্রোত নামে। নির্যাতিত গাজাবাসীর পক্ষে এত বড় জমায়েত পৃথিবীর আর কোনো দেশেই হয়নি। শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানজুড়ে নয়, আশপাশের চারদিকে কয়েক কিলোমিটার সড়কজুড়ে গাজাবাসীর পক্ষে প্যালেস্টাইনের পতাকা হাতে অংশ নেয় লাখ লাখ জনতা।
এই সময় প্যালেস্টাইনের পতাকার পাশাপাশি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকাও ছিল অগণিত মানুষের হাতে হাতে। এছাড়া অনেকের হাতে ছিল ‘ফিলিস্তিন মুক্ত করো, গাজা রক্তে রঞ্জিত, বিশ্ব কেন নীরব’ স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড। ঢাকাজুড়ে জন-প্লাবনে শুধুই ছিল প্যালেস্টাইনের পক্ষে মিছিলের গর্জন।
‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশ’ শনিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মার্চ ফর গাজা কর্মসূচির ডাক দেয়। এতে সমর্থন দেয় দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক, ধর্মীয়, পেশাজীবী সংগঠন। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে দেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষ কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানায়। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সকাল থেকে ঢাকার সব পথ মিশে যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও উদ্যানের পাশপাশের সড়কে।
এদিন পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশের কর্মসূচি ‘মার্চ ফর গাজা’র আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। গণজমায়েতে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মাওলানা আব্দুল মালেক। ফিলিস্তিনের পক্ষে সংহতি জানিয়ে বাংলা, ইংরেজি ও আরবি ভাষায় একটি ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
পরে দোয়া ও মোনাজাতের মধ্য দিয়ে আয়োজনটি শেষ হয়। ঘোষণাপত্র পাঠ করার আগে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, আল্লাহর নামে শুরু করছি, যিনি পরাক্রমশীল, যিনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন, যিনি মজলুমের পাশে থাকেন এবং জালিমের পরিণতি নির্ধারণ করেন।
আজ আমরা বাংলাদেশের জনতা, যারা জুলুমের ইতিহাস জানি, প্রতিবাদের চেতনা ধারণ করি। আজকে আমরা সমবেত হয়েছি মৃত্যু ভয়হীন ফিলিস্তিনের গাজার জনগণের পাশে দাঁড়াতে। এ সময় ইসলামিক স্কলার ড. মিজানুর রহমান আজহারী বলেছেন, জনতার এই মহাসমুদ্র ফিলিস্তিন ও আল আকসার প্রতি আমাদের ভালোবাসার প্রকাশ। ভৌগোলিকভাবে আমরা তাদের থেকে দূরে থাকলেও আজকের এই বিপুল উপস্থিতি প্রমাণ করে-আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়ে বাস করে একটি করে ফিলিস্তিন।
কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, আব্দুস সালাম আজাদ, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, জামায়াতের ঢাকা মহানগর উত্তরের সেক্রেটারি জেনারেল রেজাউল করিম ও দক্ষিণের সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুল ইসলাম মাসুদ, জনপ্রিয় ইসলামিক ইসলামী আলোচক শায়খ আহমাদুল্লাহ, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহসহ অনেকে।
কর্মসূচিতে জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গাজাবাসীর পক্ষে সংহতি জানাতে যে যার মতো করে অংশ নেয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লাখ লাখ মানুষ। তাদের মধ্যে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী, হেফাজতে ইসলাম, ধর্মভিত্তিক সংগঠনের সদস্য ও তরুণ প্রজন্মেরও উপস্থিতি ছিল লক্ষ করার মতো।
এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টি, এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টি, ১২ দলীয় জোট, জাতীয় পার্টি (জাফর), গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, জেএসডিসহ দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী সমর্থকরা নিজ নিজ উদ্যোগে অংশগ্রহণ করেন গতকালের কর্মসূচিতে। আলোচিত কয়েকজন ইসলামিক স্কলার, খেলোয়াড়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অঙ্গনের ব্যক্তিবর্গ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা একাত্মতা প্রকাশ করেন।
বিকেল ৩টায় কর্মসূচি থাকলেও সকাল থেকেই দলে দলে মানুষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসতে থাকেন তারা। এই সময় সবার হাতে বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনের পতাকা এবং বিভিন্ন স্লোগান সংবলিত প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। এক পর্যায়ে দুপুরের আগেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে বিক্ষুব্ধ জনতার স্রোত একদিকে রাজধানীর পুরানা পল্টন মোড়, মৎস্যভবন মোড়, কাকরাইল মোড়, শাহবাগ হয়ে বাংলামোটর, দোয়েল চত্বর হয়ে সচিবালয় এলাকা, টিএসসি হয়ে শহীদ মিনার, কাটাবন মোড়সহ আশপাশের পুরা এলাকায় জনতার প্লাবন সৃষ্টি হয়।
শনিবার সকালের দিকে সরেজমিন দেখা গেছে, কাওরান বাজার মোড়, বাংলামোটর, কাকরাইল মোড়, পল্টন মোড় এলাকা থেকে দলে দলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যায় মানুষ। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত ও বাইরের জেলা থেকে বাস, মিনি ট্রাক, মোটরসাইকেলসহ নানা যানবাহনে করে মানুষ এসে জড়ো হন। পরে তারা পায়ে হেঁটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে রওনা দেন।
সমাবেশে অংশ নেওয়া অনেকের হাতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা এবং ফিলিস্তিনি পতাকা দেখা গেছে। কেউ কেউ কালেমা খচিত ফিতা মাথায় বেঁধেছেন। অংশগ্রহণকারীরা ইসরায়েলবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যায়। পাশাপাশি জাতিসংঘের কাছেও জবাবদিহি চান।
সমাবেশে আসা মানুষ গাজায় ইসরায়েলের চলমান আগ্রাসনকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ উল্লেখ করে তা বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর হস্তক্ষেপ দাবি করেন। একইসঙ্গে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে জোরালো কূটনৈতিক অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
সমাবেশে উপস্থিত ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আবু মূসা বলেন, আজ আমরা গাজাবাসীর কণ্ঠস্বর। ফিলিস্তিনে প্রতিদিন শিশু মরছে, মা কাঁদছে। আমরা আর চুপ করে থাকতে পারি না। আর জাতিসংঘ ও মুসলিম বিশ্বের কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় ইসরায়েল আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এমন অবস্থা বাংলাদেশ সরকারকেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কূটনৈতিকভাবে জোরালো অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানান এই শিক্ষার্থী।
এদিকে এই জনসমাগমের মধ্যেও রাস্তার গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক ছিল। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা যায়নি সড়কে। রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক অবস্থানে দেখা গেছে। ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাকরাইল মোড়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনী এবং কাকরাইল মসজিদ মোড়ে সেনাবাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন ছিল।
মিছিল নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়া জনতাকে সেসব জায়গায় তল্লাশি করা হয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো সংগঠনের ব্যানার বা পতাকা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী কোনো বস্তু যাতে কেউ সমাবেশস্থলে নিয়ে যেতে না পারে সে জন্য ছিল এই তল্লাশি। তল্লাশির সময় কালো কাপড়ে কালেমা লেখা কোনো কাপড় বা পতাকা পাওয়া গেলে সেগুলো রেখে দিতে দেখা যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।