আজ বিশ্ব পানি দিবস: ঢাকা শহরে ৫৬টি খালের অস্তিত্ব থাকলেও তার সবই মৃতপ্রায়
‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে/ পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি/ দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি/ চিকচিক করে বালি, কোথা নাই কাদা...।’ আজ থেকে অনেক আগে লেখা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতার মতো নদীতে হাঁটুজল দূরের কথা, কোথাও পানি নেই। জানা যায়, প্রতিবছর প্রায় ছয় থেকে নয় ফুট নিচে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। ফলে পানির সংকট যেমন বাড়ছে তেমনি পানি উত্তোলনের খরচও বাড়ছে। আবার মাটির নিচে শূন্যস্থান তৈরি হওয়ায় ভূমি দেবে যাওয়ার আশঙ্কাও করছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকায় পানির উৎস দিন দিন কমে যাচ্ছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরও অনেক নিচে নেমে গেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, শহরে কমপক্ষে ১৫ ভাগ প্রাকৃতিক জলাধার থাকা দরকার। কিন্তু বাস্তবে তা চার-পাঁচ ভাগেরও কম।
তথ্যমতে, ক্রমেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি। স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। সারাদেশের চিত্র প্রায় একই। আর রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের চিত্র আরও ভয়াবহ। ঢাকা শহরে পানির স্তর প্রতিবছর ২ থেকে ৩ মিটার (৭ ফুট থেকে ১০ ফুট) নিচে নেমে যাচ্ছে। আর চট্টগ্রাম শহরে এই হার ৩ মিটার (১০ থেকে ১১ ফুট) পর্যন্ত। এদিকে দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলও মহাসংকটে। উত্তরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির অত্যধিক ব্যবহার এবং ভূগর্ভে পানির প্রবেশ ব্যাহত হওয়ায় পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। অনেক এলাকায় নলকূপে পানি উঠছে না। বিপুলসংখ্যক গভীর নলকূপ দিয়ে মাটির নিচ থেকে দিন-রাত অবিরাম পানি তোলা হচ্ছে। অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চলেও স্বাদু বা মিঠা পানির অভাব ক্রমেই তীব্র হচ্ছে।
এদিকে, নদীতে পানি না থাকায় এবার চলতি বোরো মৌসুমে বন্ধ হয়ে পড়েছিল অন্তত ৪০০ সেচ পাম্পের কার্যক্রম। এতে এসব সেচ পাম্পের আওতায় চাষ হওয়া কয়েক হাজার একর জমির বোরো ধানের আবাদ ব্যাহত হচ্ছে। নদীতে পানি না পেয়ে কৃষকেরা সেচের জন্য ক্রমেই গভীর ও অগভীর নলকূপনির্ভর হয়ে পড়ছেন। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত পানি উত্তোলনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানিও আর নিরাপদ থাকছে না অনেক সময়। ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে নদীর দূষণ কমানোর বিকল্প নেই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তথ্যমতে, নদী-নালায় ভরপুর বাংলাদেশ তারপরও প্রায় ৯৮ শতাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয় মাটির নিচে থাকা পানি। হোক তা সুপেয় পানি অথবা কৃষি কাজে কিংবা শিল্প কারখানা সবখানেই ব্যবহার করা হয় এই ভূগর্ভস্থ পানি। একটা সময় পানির চাহিদা ছিলো কম ফলে মাটি নিচ থেকে পানি তোলা হলেও বৃষ্টি পানি সেই ক্ষতি অনেকটাই পূরণ করতে পারতো। এখন যেমন মানুষ বেড়েছে তেমনি বেড়েছে শিল্প কারখানা ফলে চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ।
সূত্রমতে, শুধুমাত্র ঢাকার জন্যই প্রতিদিন ২৫ লাখ কিউবেক মিটার পানি তোলা হয় মাটির নিচ থেকে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসেব বলছে, গেলো ৫০ বছরে ঢাকার পানি স্তর আগের তুলনায় অন্তত ২৩০ ফুট নিচে নেমে গেছে। ভূ-গর্ভস্থ পানি বিজ্ঞান পরিদপ্তরের পরিচালক ড. আনোয়ার জাহিদ জানান, ঢাকার পানি স্তরের গভীরতা কমে যাওয়ায় এখন আশপাশের এলাকা থেকে ঢাকার দিকে পানি আসছে। শিল্প-কারখানাগুলো এখন সেই পানিও তুলে নিচ্ছে। শুধু ঢাকা নয় দেশের দুই তৃতীয়াংশ এলাকাতেই মাটির নিচে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। ফলে একদিকে পানির সংকট তৈরি হচ্ছে আবার ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকার মাটি ডেবে যাবার আশঙ্কাও করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ বলেন, ভূ-গর্ভস্থ পানি তোলার যে প্রবণতা আমাদের আছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে, মাটি ডেবে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে নদীর পানি ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে। তবে সেজন্য আগে প্রয়োজন নদীগুলোকে দূষণমুক্ত রাখা।
ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তথ্য মতে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় খালের সংখ্যা ৪৭। তবে রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা শহরে ৫৬টি খালের অস্তিত্ব থাকলেও তার সবই মৃতপ্রায়। এর মধ্যে দখল হয়ে যাওয়া ২৬টি খাল উদ্ধারের পরিকল্পনা দিয়েছে দুই সিটি কর্পোরেশন। বাকি খালগুলোর অস্তিত্ব তারা এখনো খুঁজে পায়নি। জানা গেছে, খাল দখলদারদের মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানও দখল করেছে। ঢাকা শহরের যে খালগুলোর কথা বলা হচ্ছে সেগুলো ঢাকার চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিলো আর জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ঢাকাসহ আশপাশের এলাকা মিলিয়ে মোট ৭৭টি খালের অস্তিত্ব চিহ্নিত করেছে।
হাজার পুকরের শহরে পুকুর নেই:
ঢাকা শহরে পুকুরের সংখ্যা ছিল দুই হাজারেরও বেশি। মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুর ছিল দুই হাজার। কিন্তু ঢাকায় এখন পুকুরের সংখ্যা একশ’র কম। জানা গেছে, যে এক হাজার ৯শ’ সরকারি-বেসরকারি পুকুর ও জলাধার ভরাট হয়ে গেছে তাতে জমির পরিমাণ ৭০ হাজার হেক্টর। ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৮৫ থেকে এ পর্যন্ত ঢাকার ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জলাভূমি, খাল ও নিম্নাঞ্চল হারিয়ে গেছে। এটা অব্যাহত থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ ঢাকায় জলাশয় ও নিম্নভূমির পরিমাণ মোট আয়তনের ১০ শতাংশের নিচে নেমে যাবে।
পানি নিয়ে বড় সংকটে ঢাকা:
নগর পরিকল্পনাবিদ ও ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, একটি শহরের মোট আয়তনের কমপক্ষে ১৫ ভাগ প্রাকৃতিক জলাধার থাকা দরকার। সেটা আবার হতে হবে এলাকা ভিত্তিক। কিন্তু ঢাকা শহরের খাল ও পুকুর যেভাবে দখল হয়ে গেছে তাতে এখন পাঁচ ভাগও আছে কী না সন্দেহ। আর যে কয়েকটি খাল আছে তাও বক্স কালভার্টের নামে আটকে দেয়া হয়েছে। নিচে খাল, উপরে রাস্তা। এই খাল বাস্তবে কোনো কাজে আসে না। তিনি জানান, ২০০০ সালের আইনেও জলাশয়, জলাধার, পুকুর ভরাট করা নিষেধ। কিন্তু কেউ মানছে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানও একই কাজ করছে। আর ব্যক্তিগত পকুর ভরাট রোধে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থাও আছে। তারপরও থামছে না। তিনি বলেন, এই পুকুর, জলাধার, খাল, জলাশয় শুধু সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য নয়, এটা আমাদের নিরাপত্তার জন্যও প্রয়োজন। ঢাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এটা যেভাবে নামছে তাতে ভবিষ্যতে পানির সংকট আরো তীব্র হবে। তাই ঢাকার নদী, পুকুর, জলাধার উদ্ধারের কোনো বিকল্প দেখি না। বড় বড় নদী থেকে ঢাকায় পানি আনার সে পরিকল্পনার কথা বলা হচ্ছে তারা চেয়ে জরুরি পুকুর, খাল ও জলাধার উদ্ধার করা।
আর বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবু নাসের খান বলেন, কেবল পানির উৎসের জন্য নয়, ঢাকা শহরে বৃষ্টির সময় যে জলাবদ্ধতা তৈরি হয় তা থেকে রক্ষার জন্য খাল, পুকুর ও জলাধারগুলো উদ্ধার প্রয়োজন। আর আমরা যদি ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভর করে বসে থাকি তাহলো তো চরম সংকটে পড়ব। কারণ পানির স্তর তো নিচে নেমে যাচ্ছে। এক সময় হয়তো গভীর নলকূপেও পানি পাওয়া যাবে না। তার কথা, আমাদের এখানকার যে শিল্প কারখানার ধরন তাতেও প্রচুর পানি প্রয়োজন। কারণ যেসব কারখানায় বর্জ্য বেশি হয়, দূষণ বেশি হয় সেগুলোই আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এক কেজি জিন্স উৎপাদন করতে ২২০ কেজি পানি লাগে। তিনি বলেন, আমাদের দুই সিটিতে যে ৪৭টি খালের হিসাব সরকারই দিচ্ছে সেই খালগুলো আগে উদ্ধার করা হোক। আর সরকারি অনেক পুকুরও ভরাট হয়েছে। পার্কের অনেক পুকুর নাই। সেগুলো উদ্ধার করা হোক।