* সড়কগুলো সংস্কার না করেই মাসের পর মাস ফেলা রাখা হচ্ছে
*ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে
বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান যখন তখন রাজধানীর সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করছে। নিয়মতান্ত্রীকভাবে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির করতে ঢাকা মহানগরীর সড়ক খনন নীতিমালা-২০১৯ গঠন করা হলেও কেউ তার তোয়াক্কা করছে না। এতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়ায় এর সাথে সংশ্লিষ্ট কাজ বন্ধ করাসহ ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সদর দপ্তর।
সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও সড়কের একপাশ কোথাও সড়কের মাঝখান দিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি করে দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হয়েছে। মাসের পর মাস পার হলেও এসব সড়ক সংস্কার করা হচ্ছে না। প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলিতে একই অবস্থা দেখা গেছে। কিছু কিছু সড়ক কোন রকম বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলা রাখা হয়েছে। ফলে এসব সড়কে চলাচল করতে গিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়ছে নগরবাসী।
অভিযোগ রয়েছে, গত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগেই অনেক সড়ক খুঁড়ে রাখা হয়েছিল। অনেক ঠিকাদার প্রভাবশালী হওয়ায় দিনের পর দিন সড়কগুলো সংস্কার না করে ফেলে রাখে। পরে সরকার পতনের পর তারা আত্মগোপনে থাকায় অধিকাংশ সংস্কার করা হয়নি। এর সাথে বিভিন্ন সংস্থার নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নীতিমালা অমান্য করায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে থাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি বলে দুই সিটি জানিয়েছে। তবে নীতিমালা বাস্তবায়নে সিটি করপোরেশনকেই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। তাদের মতে এ নীতিমালা অনুযায়ী সড়ক খনন করলে তেমন দুর্ভোগে পড়তে হবে না।
জানা গেছে, প্রতি বছরই বিভিন্ন সংস্থা সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করছে। সড়ক খনন ও পরে সংস্কার কার্যক্রমে সমন্বয় ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হচ্ছে। যারফলে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রে এসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় ঘটাতেই ২০১৯ সালের ‘ঢাকা মহানগরীর সড়ক খনন নীতিমালা’ প্রণীত হয়। দুই সিটি ছাড়াও ঢাকা ওয়াসা, তিতাস গ্যাস, ডিপিডিসি, ডেসকো, বিটিসিএলের মতামত ও সুপারিশ নিয়ে এটি চূড়ান্ত করা হয়েছিল। অথচ সড়ক খনন নীতিমালা অনুযায়ী কোনো সড়কের পুরোটা একসঙ্গে খোঁড়া যাবে না। মাসের পর মাস একটানা কোনো সড়ক খোঁড়া যাবে না। ১৫ দিনের কয়েকটি ভাগে ভাগ করে কাজ করতে হবে। ধুলাবালি উড়ে যাতে জনগণের ভোগান্তি না হয়ে, সে জন্য নিয়মিত পানি ছিটাতে হবে। হলুদ বা লাল ফিতা দিয়ে খনন এলাকা ঘিরে রাখতে হবে। চলাচলে বিঘ্ন ঘটিয়ে মালামাল মজুত করে রাখা যাবে না। বিভিন্ন সংস্থা থেকে নিয়োজিত ঠিকাদারদের চুক্তিতে নীতিমালার সব শর্ত মেনে চলার বাধ্যবাধকতা যুক্ত থাকবে। নীতিমালার কোনো শর্তের ব্যত্যয় হলে ঠিকাদারকে জরিমানা বা শাস্তি দেওয়া হবে। এছাড়া, সড়ক খনন নীতিমালা অনুযায়ী সিটি করপোরেশনকে না জানিয়ে সড়কে খননকাজ শুরু করলে মূল খরচের পাঁচ গুণ জরিমানা গুনতে হবে। কিন্তু এর কোনটিই মানছে না সংশ্লিষ্টরা। এখন প্রশ্ন হলো তাহলে নীতিমালা করে কি লাভ হলো। মূলত নামেই করা হয়েছে এ নীতিমালা। কার্যত এটা কেউ মানছে না। ফলে এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন থেকে কার্যকর কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় নগরবাসীর দুর্ভোগ কমাতে ডিএমপির সদর দপ্তর থেকে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়াসহ নানা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী স্বাক্ষরিত এক গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া ঢাকার কোনো রাস্তা কাটাকাটি ও খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করা যাবে না। ডিএমপির সম্মতি ছাড়া যদি কোনো প্রতিষ্ঠান রাস্তা কাটাকাটি, খোঁড়াখুঁড়ির শর্ত ভঙ্গ করে ঢাকায় যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট কাজ বন্ধ করাসহ ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে ডিএমপি। গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঢাকা মহানগরীর রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি করে বিভিন্ন কাজ দিনের পরিবর্তে রাতে সঠিকভাবে দ্রুত সম্পাদনে কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগরীতে প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়, কিছু কিছু সংস্থা/ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দিনের বেলা বিভিন্ন ইউটিলিটি সার্ভিসের কাজের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে থাকে, যা পুনঃমেরামত করতে অনেক সময় ৭/৮ মাস লেগে যায়। প্রায় সবক্ষেত্রে যানবাহন চলাচলের জন্য বিকল্প রাস্তা তৈরি না করেই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়। সব খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি জায়গা কর্তন করা হয়। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির সময় ট্রাফিক সিগন্যালের জন্য দিক-নির্দেশনা সম্বলিত সাইনবোর্ড লাগানোর বিধান থাকলেও তা করা হয় না। এক লেনে খোঁড়াখুঁড়ি করে মাটি/আবর্জনা অন্য লেনে ফেলে রাখার ফলে দুই লেনের যান চলাচল ব্যাহত হয়।
এসব কারণে ঢাকা মহানগরীর যানজট বৃদ্ধি পেয়ে জনভোগান্তি সৃষ্টি হয় এবং যানবাহন রাস্তায় অলসভাবে বসে থাকার ফলে শ্রমঘণ্টা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়। ইউটিলিটি সার্ভিসের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি/কাটাকাটির ক্ষেত্রে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে কিছু নির্দেশনা যথাযথভাবে প্রতিপালন করার জন্য সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা এবং ঠিকাদারকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে, ডিএমপি সদর দপ্তরের সম্মতি ছাড়া রাস্তা কাটাকাটি ও খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শুরু না করা। সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে কোনো রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ না করা। এক্ষেত্রে রাতে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করে সকালে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে।
এছাড়া, রাস্তা কাটার আগে কিছু বিষয় নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এরমধ্যে কাজ শুরু এবং শেষ করার সময় (অর্থাৎ কোন তারিখে কাজ শুরু এবং শেষ হবে তা) পূর্বেই ঘোষণা করতে হবে এবং ওই সময়ের মধ্যে অবশ্যই কাজ শেষ করতে হবে। রাস্তা খননের স্থান ও এর আগে-পরে ২০০ মিটার পর্যন্ত যথাযথ ট্রাফিক নির্দেশনা এবং ট্রাফিক সিগন্যাল লাইট লাগাতে হবে। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল অবশ্যই নিয়োগ করতে হবে। পথচারী এবং যানবাহন চলাচলের জন্য অবশ্যই বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা করতে হবে। কাটা রাস্তা ব্যবহার উপযোগী করার জন্য লোহার শিট রাস্তা কাটার আগেই সেখানে আনতে হবে। রাস্তার একটা লেন রাতের বেলা কাটা যেতে পারে, তবে সেটা অবশ্যই সূর্যোদয়ের আগেই ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই একই রাস্তার উভয় পাশে একসঙ্গে খোঁড়াখুঁড়ি করা যাবে না।
ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের প্রতিনিধিসহ রাতে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করতে হবে। কোনো রাস্তা রাত্রিকালে সর্বোচ্চ ৭ দিন খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করা যাবে এবং পরবর্তী তিন রাতের মধ্যে মেরামত করে দিতে হবে, এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সংখ্যক শ্রমিক ও টেকনিশিয়ান নিয়োগ করতে হবে। যারা এ নির্দেশনা না মানবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে স্থাপতি ইকবাল হাবিব বলেন, জনগণের দুর্ভোগ কমাতে সড়ক খনন নীতিমালার কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নীতিমালাটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দুই সিটির। অনুমতি ছাড়াই কেউ রাস্তা খুঁড়লেই আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই এ সমস্যা সমাধান হবে। আর ডিএমপি থেকে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সেটা বাস্তবায়ন হলেও সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি দুর্ভোগ কমে আসবে বলে আশা করা যায়।