ই-পেপার বাংলা কনভার্টার বুধবার ● ১৯ মার্চ ২০২৫ ৫ চৈত্র ১৪৩১
ই-পেপার বুধবার ● ১৯ মার্চ ২০২৫
Select Year: 
ব্রেকিং নিউজ:




গণিত শাস্ত্র এবং মরিয়ম মির্যাখানি
শামীমা জাহান জলি
প্রকাশ: শুক্রবার, ৭ মার্চ, ২০২৫, ৪:১৭ পিএম  (ভিজিটর : ১৯৩)
যে সকল মহামানব নারীকে তার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে, ঘুরে দাঁড়াতে, বিজয়ী হতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ও অসামান্য হলেন ইরানি গণিতবিদ মরিয়ম মির্যাখানি। কেননা গণিতে ‘ফিল্ডস পদক’ জয়ী এই অনন্য প্রতিভাধরের পূর্বে কোনো নারী গণিতে এতখানি পারদর্শিতা দেখানোর সাহস করেননি। আমাদের সমাজে নারীর মস্তিষ্ককে অনুর্বর বলে গণ্য করা হয় এবং সেখানে গৃহস্থালি কাজের চাষাবাদই বেশি হয় বলে ধারণা করা হয়। তবে গণিতের কঠিন থেকে কঠিনতর বিষয়েও যে নারী পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করতে পারে তার প্রমাণ মরিয়ম মির্যাখানি। 
তিনি গণিতের যেসব উচ্চমার্গীয় বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন সেগুলো হলো বক্রপৃষ্ঠের প্রতিসাম্য, টাইখমুলার জগৎ, হাইপারবলিক জ্যামিতি, এরগডিক তত্ত্ব, সিম্পলেকটিক জ্যামিতি ইত্যাদি। গণিতের এ দুর্বোধ্য বিষয়গুলো অনেক তুখোড় গণিতবিদও এড়িয়ে চলেন ।
মরিয়ম মির্যাখানি ১৯৭৭ সালের ১২ মে ইরানের তেহরান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণ ছিল তাঁর। সুযোগ পেলেই বই কিনতেন এবং তা পড়ে ফেলতেন। লেখাপড়া করেছেন ফারজানেগান স্কুলে। তিনি টেলিভিশনে বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনীর প্রামাণ্যচিত্র দেখতেন। এ জীবনীচিত্র তাঁকে বড়  কিছু হওয়ার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে, বিশেষ করে নোবেল বিজয়ী নারী বিজ্ঞানী মেরি কুরি এবং অসাধারণ মেধাবী লেখক হেলেন কিলারের জীবনী। অর্থাৎ শৈশব থেকেই অসাধাারণ কিছু একটা হয়ে দেখানোর প্রবল সদিচ্ছা ছিলো তাঁর মনের গহীনে। “একটি বই একশোটি বন্ধুর সমান কিন্তু একজন ভালো বন্ধু পুরো লাইব্রেরির সমান” ড. এপিজে আব্দুল কালামের এ অসাধারণ উক্তিটি সার্থক প্রতিপন্ন হয়েছে মির্যাখানির জীবনে। কেননা রয়া বেহেশতি নামক তাঁর একজন বন্ধু রয়েছে যিনি সবসময় মির্যাখানির পাশে ছিলেন । 
গণিতে সর্বোচ্চ পুরস্কারপ্রাপ্ত মরিয়ম মির্যাখানি ছোটবেলায় গণিতে খুব একটা ভালো ছিলেন না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন গণিত পরীক্ষার ফলাফল সন্তোষজনক ছিল না। তারপর সৌভাগ্যক্রমে এমন একজন শিক্ষকের সাহচার্য লাভ করেন যিনি মির্যাখানির গাণিতিক চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। ফলত তিনি গণিতের ভীতি কাটিয়ে ওঠেন এবং এ শাস্ত্রে পারদর্শিতা লাভ করেন ।
সালটা ১৯৯৪, মরিয়ম মির্যাখানি তখন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী; এ সময়ে তার হাতে আসে ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডের প্রশ্ন। এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীদের প্রোগ্রামিংয়ের দক্ষতা নিরুপণ করা হয়। অত্যন্ত জটিল এই প্রশ্নে সমস্যা ছিল মোট ৬টি। মির্যাখানি এবং রয়া বেহেশতি দুজন মিলে দুদিন অক্র্যান্ত পরিশ্রম করে তিনটি সমস্যার সমাধান করে ফেললেন। তাই অত্যন্ত প্রফুল্ল চিত্তে চলে গেলেন স্কুল প্রধানের কাছে। তবে তখন গাণিতিক সমস্যা সমাধানের ক্লাসে মেয়েদের প্রবেশাধিকার ছিল না। তবে স্কুল প্রধানের ইতিবাচক মনোভাবের কারণে তাঁরা প্রবলেম সলভিং ক্লাসের অনুমতি লাভ করেন। সমস্যা এখানেই শেষ নয়, তখনো পর্যন্ত কোনো নারী ইরান থেকে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করেননি। তাই তাদের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত ছিল না। তবে তাঁরা যেমন দমে যাননি, তেমনি সুদৃঢ় ভূমিকা পালন করেন স্কুল প্রধান। স্কুল প্রধানের ভাষায়, ‘এর আগে কোনো মেয়ে অংশগ্রহণ করেনি তার মানে এই না যে তোমরাও অংশগ্রহণে ব্যর্থ হবে। বরঞ্চ তোমরাই হবে এদেশের নারীদের পক্ষ থেকে প্রথম নারী প্রতিযোগী। সত্যিই তা-ই ঘটল, তাঁরাই হলেন এ বিখ্যাত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী প্রথম ইরানি নারী। এ অন্ষ্ঠুানটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল চীনের হংকংয়ে। এ প্রতিযোগিতায় মির্যাখানি মোট ৪২য়েন্টের মধ্যে ৪১ পয়েন্ট অর্জন করেন এবং স¦র্ণপদক লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন। ১৯৯৫ সালেও তিনি এ প্রতিযোগিতায় যোগদান করেন। এবার তিনি ৪২ পয়েন্ট অর্জন করেন এবং  আবারও স্বর্ণপদকে ভূষিত হন ।
এই মহীয়সী নারী ১৯৯৯ তেহরানের শরিফ ইউনির্ভাসিটি  অব টেকনোলজি থেকে গণিতে স্নাতক  সম্পন্ন করেন। এরপর বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনির্ভাসিটিতে। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই মাস্টার্স এবং পিএইচডি শেষ করেন ২০০৪ সালে। পিএইচডি করার সময় তিনি ফিল্ডস পদক জয়ী অধ্যাপক ম্যাকমুলানের সংস্পর্শে আসেন। এসময় তিনি অধিবৃত্তিক জ্যামিতি নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁর থিসিসের বিষয় ছিল ‘হাইপারবলিক পৃষ্ঠের সরল জিওডেসিক এবং বক্ররেখার মডিউলি  স্থানের আয়তন’। 
২০০৪ সালে  তিনি ক্লে গণিত ইনস্টিটিউটে একজন গবেষণা ফেলো হিসেবে যোগদান করেন । ২০০৮ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়সে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। যেখানে তিনি আমৃত্যু তার গবেষণা চালিয়ে যান। তিনি দীর্ঘ সময় নিয়ে গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতেন। এ কাজে তিনি কাগজের পাতায় ডুডল আঁকতেন এবং অঙ্কনের চারপাশে গাণিতিক সূত্র লিখতেন। তাঁর একমাত্র মেয়ে আনাহিতা তার মায়ের কাজকে ‘চিত্রকলা ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাই দুর্বোধ্য সব বিষয়ে অনায়াসে প্রবেশ করতেন। তিনি নিজেকে একজন ধীর গণিতবিদ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘গণিতের সৌন্দর্য দেখার জন্য আপনাকে কিছু শক্তি, শ্রম এবং প্রচেষ্টা ব্যয় করতে হবে ।
তিনি গবেষণা করেন জ্যামিতিক কাঠামোর জটিল অব থান এবং জটিল গতিশীলতার উপর, বিশেষ করে মডুলি স্পেস এবং রিম্যান পৃষ্ঠের উপর জোর দিয়ে। তাঁর অসামান্য নৈপুণ্যতায় এবং অপরিসীম পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি গণিতের অত্যন্ত জটিল এ ক্ষেত্রটিকে উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে নিয়ে যান। ব্যাপক প্রশংসা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেন। ফলশ্রুতিতে ২০১৪ সালে গণিতের সর্বোচ্চ  সম্মাননা  ফিল্ডস পদকে ভূষিত হন । এটি গণিতের নোবেল হিসেবে খ্যাত। প্রতি ৪ বছর পরপর অনূর্ধ্ব ৪০ বছর বয়সী  ২, ৩ কিংবা ৪ জন বিজ্ঞানীকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন ইরানি নারী গণিতজ্ঞ এই সম্মাননা লাভ করেন।
এই পদকের মাধ্যমে তিনি সমগ্র নারী জাতিকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। কেননা এর আগে কোনো নারী গণিতে এতোবড়ো সম্মাননা লাভ করেননি। নারীও যে মুক্ত চিন্তা করতে পারে, দুর্বোধ্য বিষয় বুঝতে পারে, দীর্ঘ সময় একটা সমস্যা নিয়ে গবেষণা করতে পারে, সফলতা অর্জন করতে পারে, নিজের দেশকে গৌরবান্বিত করতে পারে এই পুরস্কার তারই প্রমাণপত্র। নারীর জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়নে এই পদক অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। আর তাইতো ফিল্ডস পদক গ্রহণের সময় অত্যন্ত বিনয়ী মির্যাখানি বলেন,‘নারীরা যেন অনুপ্রাণিত হন তাই আমি পুরস্কারটি গ্রহণ করছি’। তার ঝুড়িতে আরো রয়েছে ব্লুমেনথাল পুরস্কার (২০০৯), স্যাটার পুরস্কার (২০১৩), ক্লে রিসার্চ এ্যাওয়ার্ড (২০১৪) ইত্যাদি পুরস্কার ও সম্মাননা। 
কিন্তু  ২০১৩ সালে এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের জীবনে নেমে আসে অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার । তাঁর স্তন ক্যানসার ধরা পড়ে। ২০১৬ সালে তা হাড় এবং লিভারে ছড়িয়ে পড়ে। উল্কা পিণ্ডের পতনের মতোই তার জীবন প্রদীপ নিভে আসে। স্বামী, সন্তান এবং অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগীকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ২০১৭ সালের ১৪ জুলাই মাত্র ৪০ বছর বয়সে পরলোকে পাড়ি জমান ।  
লেখক : প্রাক্তন সহকারি শিক্ষক, সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজ, সাভার, ঢাকা।







সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক : কে.এম. বেলায়েত হোসেন
৪-ডি, মেহেরবা প্লাজা, ৩৩ তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত এবং মনিরামপুর প্রিন্টিং প্রেস ৭৬/এ নয়াপল্টন, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
বার্তা বিভাগ : ৯৫৬৩৭৮৮, পিএবিএক্স-৯৫৫৩৬৮০, ৭১১৫৬৫৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন ঃ ৯৫৬৩১৫৭, ০১৭১২-৮৮৪৭৬৫
ই-মেইল : [email protected], [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
বার্তা বিভাগ : ৯৫৬৩৭৮৮, পিএবিএক্স-৯৫৫৩৬৮০, ৭১১৫৬৫৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন ঃ ৯৫৬৩১৫৭, ০১৭১২-৮৮৪৭৬৫
ই-মেইল : [email protected], [email protected]