ই-পেপার বাংলা কনভার্টার বুধবার ● ১৯ মার্চ ২০২৫ ৫ চৈত্র ১৪৩১
ই-পেপার বুধবার ● ১৯ মার্চ ২০২৫
Select Year: 
ব্রেকিং নিউজ:




নিউ দিল্লীর ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফেয়ার
এ. এইচ. রঞ্জু
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১:১৩ পিএম  (ভিজিটর : ৮৮)

১৯৮৬ সাল। ডিসেম্বর মাস। নতুন দিল্লির প্রগতি ময়দানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। এই মেলায় যোগ দেয়ার সুযোগ পেলাম। এটাই ছিল আমার প্রথম দিল্লি যাত্রা। কলকাতার হাওড়া স্টেশন। বিশাল এই স্টেশন থেকে ট্রেনে যাত্রা শুরু। 
রাইসিনা নামক একটি পাহাড়। এই পাহাড়ের ক্লিফ বা চূড়ায় দিল্লির অবস্থান। দিল্লি শহরে দেখার মতো অনেক কিছু আছে। যেমন: কনটপ্লেস, পালিকা মার্কেট ( মাটির নিচে), রাষ্ট্রপতি ভবন, ইন্ডিয়া গেট,তিন মূর্তি  ভবন,ইন্দিরা মেমোরিয়াল,কমলের মন্দির,  বড় মসজিদ বা জামিয়া মসজিদ,লালকেল্লা, কুতুব মিনার ইত্যাদি। ঐতিহাসিক এই শহরটি দেখার জন্য মনে চাপা উত্তেজনা। ট্রেনটা একটু দুলে উঠলো। চলা শুরু করেছে ট্রেন। ক্রমেই ট্রেনের গতি বাড়তে থাকল। ছুটে চলেছে ট্রেন দিল্লির উদ্দেশ্যে। 
আমি জানালার ধারে বসে আছি। প্রথমে বাংলা, বিহার,  উত্তর প্রদেশ, তারপর দিল্লি। হাওড়া থেকে প্রায় ১৮০০ কিলোমিটারের পথ। সন্ধ্যায় স্নাক্স ও কফি খেলাম। ট্রেন পরদিন রাত আটটায় দিল্লি পৌঁছাবে। রাতের খাওয়া শেষে স্লিপিং বার্থে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে গেলাম। ব্রেকফাস্টের পর কফি। শরীরের আড়ষ্ট ভাব কেটে গেল। আমার পাশে দু'জন ছেলে। সমবয়সী। সামনের সিটে মাঝ বয়সী একজন মহিলা। সুদর্শনা। তার পাশে এক যুবতী। যুবতীও  সুদর্শনা। আমি লক্ষ্য করলাম,তাদের  হাতে পায়ের প্রত্যেকটি আঙ্গুলে আংটি। বুঝলাম, ওরা মাড়োয়াড়ী। 
হঠাৎ করেই আমাদের ভেতর আলাপ শুরু হল। আমি বাংলাদেশী সেটা জানালাম তাদের। আমার পাশের দুজন ছেলে-জয়পুর ইউনিভার্সিটির ছাত্র। যুবতী দিল্লী ইউনিভার্সিটির ছাত্রী এবং মহিলা দিল্লি ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। এরা চারজন পরস্পরের আত্মীয়। মহিলা প্রফেসর আমার কাছ থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা  বিষয়ে জানতে চাইছেন। আমি তার প্রশ্ন অনুযায়ী উত্তর দিচ্ছি। ওরা বাংলা জানেনা। কথা হচ্ছিল হিন্দি এবং ইংরেজিতে। 
হঠাৎ প্রফেসর মহিলা আমাকে প্রশ্ন করলেন,' ইউ ওয়ার বেটার হোয়েন ইউ ওয়ার  নট ইন্ডিপেন্ডেন্ট। ইওর পার ক্যাপিটাল ইনকাম ওয়াজ মোর। নাউ ইট'স লেস। সো হোয়াট ডিড ইউ গেইন ফ্রম ইন্ডিপেন্ডেন্স?'
'ইন্ডিপেন্ডেন্স ইজ সিমিলার টু এ মাদার'স লাভ। ওয়ান ক্যান নট গেজ দ্যা ভ্যালু অব ইন্ডিপেন্ডেন্স উইথ মানি। দোজ হু আর
নট ইন্ডিপেন্ডেন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যা একচুয়াল ভ্যালু অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স।' প্রফেসর মহিলার প্রশ্নের উত্তরে আমি যা বললাম, বাংলায় তা এরকম:স্বাধীনতা মাতৃস্নেহের ন্যায়। অর্থ দিয়ে তা নিরূপণ করা যায় না।
প্রফেসর মহিলা একটু থমকে গেলেন। আমার কথার সদুত্তর খুঁজে না পেয়ে আমাকে খাটো করার জনআবারবললেন,'ইউ পিপল আর ট্রেইটরস। ইউ কিল্ড শেখ মুজিব।' বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য মহিলা আমাকে বিশ্বাসঘাতক বললেন। 
জবাবে আমি বললাম,' দ্য মার্ডার অফ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অ্যালং উইথ হিজ ফ্যামিলি ইজ ভেরি স্যাড এন্ড ট্রাজিক। ভ্ঁবঁঁবববুববাট ইউজিং দিস রিজন আই ক্যান কল ইউ ট্রেইটর টুয়াইস।' বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা অত্যন্ত বেদনার। কিন্তু আপনার যুক্তি অনুযায়ী আপনাকে আমি দুবার বিশ্বাসঘাতক বলতে পারি। 
'হুয়াই এন্ড ইন হোয়াট ওয়ে?' প্রফেসর মহিলার প্রশ্ন কেন--- কিভাবে?
'ইউ পিপল কিলড শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এন্ড  মহাত্মা গান্ধী।' শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং মহাত্মা গান্ধীকে আপনারা হত্যা করেছেন। অতএব, আমি আপনাদের দু'বার বিশ্বাসঘাতক বলতেই পারি। আমার কথায় মহিলা চুপ হয়ে গেলেন। 
এবার যুবতী আমার দিকে একটি প্যাকেট এগিয়ে দিল। 
'ইয়ে দিল্লিকা লাড্ডু। বহুত আচ্ছা। লিজিয়ে।'
সুন্দরী যুবতীর আহ্বান। আমি একটি লাড্ডু নিলাম। মুখে দিয়ে বললাম,' দিল্লিকা লাড্ডু জো ভি খায়া,ও ভি পাস্তায়া। জো নাহি খায়া।  ও  ভি পাস্তায়া। হাম তো খা লিয়া, মেরা কেয়া হো গা?' দিল্লির লাড্ডু যে খায়, সে পস্তায়। আর যে খায় না, সে-ও পস্তায়। আমি খেয়েছি। আমার কি হবে?
আমার কথা শেষে সবার মাঝে শুরু হল অট্টহাসি। আমরা সবাই একে অপরের খুব কাছাকাছি হয়ে গেলাম। দুপুর পার হয়ে বিকেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। সামনে গাজিয়াবাদ। তারপর যমুনা নদীর উপর ব্রিজ। ওরা বলে, যমুনাজী  কি ব্রীজ। এই ব্রিজ পেরিয়ে ট্রেন ঢুকবে দিল্লি শহরে। এই সময় আমার সহযাত্রী চারজন (প্রফেসর মহিলা, যুবতী, দু'জন ছাত্র) নিজেদের মধ্যে কথা বলা শুরু করলো। ওরা আমাকে নিয়ে কথা বলছে, এটা আমি বুঝতে পারিনি। বুঝলাম, যখন প্রফেসর মহিলা বললেন,'আপনি দিল্লিতে নতুন। যাবেন পাহাড়গঞ্জ (রামনগর)। ওরা দু'জন (ছাত্র) আপনার সাথে যাবে।'

আমি প্রথমে মৃদু আপত্তি করলাম। আমার সহযাত্রীরা কর্ণপাত করলো না। 
রেলওয়ে স্টেশন, পুরানো  দিল্লি। ট্রেন থেকে নামলাম। প্রফেসর মহিলা ও যুবতী মিষ্টি হেসে বিদায় জানালো। স্টেশনের বাইরে এসে আমার সঙ্গী  দু'জন ট্যাক্সি নিল। ট্যাক্সি নিয়ে রওনা হলাম। নিউ দিল্লি রেলওয়ে স্টেশনের সামনে পাহাড়গঞ্জ বা রামনগর। এই এলাকায় অনেক হোটেল আছে। আমাকে একটি হোটেলে উঠতে হবে। অনেক চেষ্টার পর  হোয়াইট  হাউজ নামে একটি হোটেলে সিট পেলাম। সিঙ্গেল রুম নেই। ডবল রুম, এটাচ্ড্ বাথ। ভাড়া চার শত রুপি। আজ থেকে প্রায় ৩৫ বছর আগের কথা। তখন চার শত রুপি অনেক টাকা। আমার সহযাত্রীরা পকেট থেকে টাকা বের করলো। ভাড়া দেবার জন্য। 
ট্যাক্সি ভাড়া ওরাই দিয়েছে। আমিও দ্রুত পকেট থেকে টাকা বের করে বললাম,'আমার কাছে টাকা আছে। রুম ভাড়া দিতে হবে না। '
ওরা বিদায় নিল। এই ঘটনাটি আমার হৃদয়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী ছাপ এঁকে দিল।   
প্রফেসর মহিলা, যুবতী, ছাত্র দু'জন - ওদের কথা এখনো আমার মনে পড়ে। প্রায় তিন যুগ    অতিক্রান্ত হয়েছে। স্মৃতির পাতায় ওরা এখনো উজ্জ্বল। 
পরদিন সকাল। নাস্তা শেষে আমি রওনা হলাম সাকেতের উদ্দেশ্যে। এখানে আমার এক পূর্ব পরিচিত থাকে। দিল্লি আসার আগে ওর সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছিল। ওর রুমে থাকার ব্যবস্থা হল। সাকেত এলাকাটি পাথুরে। অনুপম সিনেমা হলের সামনে গাড়ি থেকে নামলাম। হলটির বিপরীত দিকে  জনতা ফ্ল্যাট। দোতলার একটি প্রশস্ত রুম। 
রুমের ভিতর হিটার। আরামদায়ক উষ্ণতা।  দিল্লিতে তখন প্রচন্ড শীত। বিকালের পর দিল্লি শহরটি কুয়াশার চাদরে আবৃত হয়ে যায়। আমি ভবনটির ছাদে গেলাম। দেখতে পেলাম কুতুব মিনারের চূড়া। কুতুব মিনার অতি সন্নিকটে।
বিকেল বেলা। গেলাম প্রগতি ময়দানে। এই ময়দানে বসেছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার আসর। গেলাম বাংলাদেশ প্যাভেলিয়নে। নেপালের প্যাভিলিয়ন আমাদের প্যাভিলিয়নের পাশে। নেপালকে রিপ্রেজেন্ট করছে পূর্ণিয়া ঢাকাল নামে এক যুবক। এই যুবকের সাথে আলাপ-পরিচয় হলো। সন্ধ্যার পর পূর্ণিয়া ঢাকাল আমাকে নিয়ে গেল ওর হোটেলে। ট্যাক্সিতে আমরা পৌঁছালাম হোটেল অশোকায়। হোটেলটি তারকা বিশিষ্ট। সম্ভবত  পাঁচ তারকা (ফাইভ স্টার)। বোঝা যায়, হোটেল অশোকা অভিজাত। রাজীব গান্ধী যখন পাইলট ছিলেন, তিনি প্রায়ই এই হোটেলে আসতেন। পূর্ণিয়া ঢাকালের রুমে আমাদের অনেক কথা হলো। তখন নেপালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল খারাপ। তাই পূর্ণিয়ার কথায় ছিল হতাশার সুর। ওর কথা আজও মনে পড়ে। শেষ হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা।   

এবার আমার পূর্ব পরিচিত আমাকে নিয়ে গেল সাউথ ব্লকে। ডাক্তার গোলাম ইয়াজদানীর বাসায়।  তিনি তখন দিল্লি লোকসভার সভার সদস্য বা মেম্বার অফ পার্লামেন্ট। এই এলাকার বিল্ডিং গুলো দোতলা। এমপি সাহেবরা থাকেন। সাউথ ব্লক এর বিপরীত দিকে নর্থ ব্লক। মাঝে সুপ্রশস্ত রাস্তা। এই সোজা চওড়া রাস্তাটি নর্থ ব্লক ও সাউথ ব্লককে দু'ভাগে বিভক্ত করেছে।
নর্থ ব্লকে ভারতের প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ বসেন। বলা হয়, তারাই ভারতকে পরিচালনা করেন। রাষ্ট্রপতি ভবনের পাশ দিয়ে এই রাস্তাটি বেরিয়ে এসেছে। সোজা চলে গেছে তিন মূর্তি ভবন পর্যন্ত। তিনমূর্তি ভবন ভারতের একটি ঐতিহাসিক ভবন। ভারতের রুপিতে তিন মূর্তির যে ছবি আছে, সেই ছবি এই ভবন থেকে নেয়া। সুপরিসর রাস্তাটি এই ভবনের সামনে এসে দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে ডানদিকে ও বাম দিকে চলে গেছে। বাঁদিকে কিছু দূর যাবার পর রয়েছে আকবর রোড ও  সফদার জং রোডের সংযোগস্থল। এই রাস্তাটিও চওড়া। রাস্তার দু'ধারে রয়েছে সারি সারি নিম গাছ। বাতাস পরিশোধিত করার ক্ষমতা নিম গাছের বেশি। এলাকাটি বেশ  নির্জন ও নিরিবিলি। এই রাস্তার ধারে বাঁদিকে রয়েছে ইন্দিরা মেমোরিয়াল। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ের শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এই ভবনে বাস করতেন। বিয়ন্ত সিং, কেহারসিংরা শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে এই ভবনের ভিতরে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। 
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, হেল কমান্ডো গ্রন্থের লেখক।







সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক : কে.এম. বেলায়েত হোসেন
৪-ডি, মেহেরবা প্লাজা, ৩৩ তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত এবং মনিরামপুর প্রিন্টিং প্রেস ৭৬/এ নয়াপল্টন, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
বার্তা বিভাগ : ৯৫৬৩৭৮৮, পিএবিএক্স-৯৫৫৩৬৮০, ৭১১৫৬৫৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন ঃ ৯৫৬৩১৫৭, ০১৭১২-৮৮৪৭৬৫
ই-মেইল : [email protected], [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
বার্তা বিভাগ : ৯৫৬৩৭৮৮, পিএবিএক্স-৯৫৫৩৬৮০, ৭১১৫৬৫৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন ঃ ৯৫৬৩১৫৭, ০১৭১২-৮৮৪৭৬৫
ই-মেইল : [email protected], [email protected]