বিশ্বে বায়ুদূষণে সবচেয়ে বেশি অকাল মৃত্যু হয় এশিয়ায়। এর মধ্যে বায়ুদূষণের কারণে শীর্ষ চতুর্থ অকাল মৃত্যুর দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। দেশিয় এক গবেষণা বলছে, বায়ুদূষণে প্রতিবছর ৫ হাজার ২৫৮ শিশুসহ ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৬ জন মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। একই কারণে বছরে ৯ লাখ মায়ের অকাল প্রসব হচ্ছে এবং প্রায় ৭ লাখ কম ওজনের শিশু জন্মগ্রহণ করছে। সেন্টার ফর রিসার্চ অন অ্যানার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরইএ) এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। বায়ুদূষণে সবচেয়ে বেশি অকাল মৃত্যুর মহাদেশ এশিয়া নিয়ে প্রকাশিত এক বৈশ্বিক গবেষণায় বলা হয়, বিগত চার দশকে এই মহাদেশে ৯ কোটি ৮০ লাখের বেশি মানুষ অকালে প্রাণ হারিয়েছে। যাদের বেশির ভাগই চীন ও ভারতের। এ ছাড়া পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া ও জাপানে অকালে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা ২০ থেকে ৫০ লাখ।
*প্রতিবছর ৯ লাখ মায়ের অকাল প্রসব হচ্ছে এবং কম ওজনের শিশু জন্মগ্রহণ করছে ৭ লাখ
*উন্নত বায়ুমান বাঁচবে ৮০ হাজার জীবন
*ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনার বায়ুদূষণে ৩০ শতাংশ ভূমিকা রাখে ভারত থেকে আসা দূষিত বায়ু
*বায়ুদূষণে সবচেয়ে বেশি অকাল মৃত্যু হচ্ছে এশিয়ায়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘এল নিনো’ এবং ‘দ্য ইন্ডিয়ান ওশান ডাইপোল’-এর মতো আবহাওয়া সংশ্লিষ্ট বিষয় বাতাসে দূষণের উপাদানগুলোর ঘনত্ব বাড়ানোর মাধ্যমে এগুলোর প্রভাবকে পরিবেশকে আরও মারাত্মক করে তুলেছে। আর বাতাসে ঘুরে বেড়ানো পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫ বা পিএম ২.৫ ক্ষুদ্র কণার নিশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করাটা বেশ ক্ষতিকর। কারণ, এগুলো রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করার মতো যথেষ্ট ক্ষুদ্র। এর বাইরে মানবসৃষ্ট বিভিন্ন গ্যাস নির্গমন আর অন্যান্য উৎস এ দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে বলে মনে করেন তারা।
গবেষণায় বলা হয়, বায়ুদূষণ সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে প্রতিবছর ৬ লাখ ৭০ হাজার রোগী হাসপাতারের জরুরি বিভাগে ভর্তি হচ্ছেন। এর ফলে সম্মিলিতভাবে বছরে ২৬৩ মিলিয়ন কর্মদিবস হারাচ্ছে মানুষ। এর বাইরে বায়ু দূষণের কারণে হার্ট ডিজিস, স্ট্রোক, হাপানি-শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও ফুসফুস ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধীতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে উন্নত বায়ুমান নিশ্চিত করা সম্ভব হলে বছরে ৮০ হাজার মানুষের জীবন রক্ষা হবে। পাশাপাশি এক বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকে বাঁচবে। মূলত মানবসৃষ্ট বিভিন্ন গ্যাস নির্গমন আর অন্যান্য উৎস এ দূষণের কারণ বলে মনে করছেন পরিবেশ বিশেজ্ঞরা।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক ২০২২ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ু দূষণ এবং জনস্বাস্থ্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়, উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাতাসের প্রভাবের কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনার বায়ুদূষণে ৩০ শতাংশ ভূমিকা রাখে ভারত থেকে আসা দূষিত বায়ু। এগুলো বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া গুরুত্ব দিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা।
গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে সিআরইএ ও বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যায়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশে ‘সূক্ষ্মকণা বায়ু দূষণে জনস্বাস্থ্য প্রভাব’ শীর্ষক আলোচনায় ওই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত গবেষণায় আরও বলা হয়, বাংলাদেশে ২০২৩ সালে বিশ্বের শীর্ষ দূষিত দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে। যেখানে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে অতি ক্ষুদ্র বালু কণার বার্ষিক মান ৭৯ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম; যা বার্ষিক জাতীয় মানদন্ড ৩৫ মাইক্রোগ্রামের দ্বিগুণের বেশি। এ কারণে উচ্চতর স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। ২০১৯ সালে সার্বিকভাবে এই ব্যয়গুলো ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল। যা বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদন্ড ৫ মাইক্রোগ্রামের তুলনায় ১৫ গুণ বেশি। বাতাসের এমন চরম দূষণ জনস্বাস্থ্যের ওপর অনিবার্য পরিণতি ডেকে আনছে। বিভিন্ন বয়সীরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হবার পাশাপাশি ৫ বছর কম বয়সী শিশুদের ওপর সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।
গবেষকরা মনে করেন, বায়ুদূষণের প্রভাবে উদ্বেগজনক স্বাস্থ্য সংকটের মধ্যেই ২০২২ সালে সরকার প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ধূলি কণার জাতীয় মান ১৫ মাইক্রোগ্রাম থেকে বাড়িয়ে ৩৫ মাইক্রোগ্রাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল; যা গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টির পাশাপাশি বায়ুর মান অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে। প্রতিবেদন বিশ্লেষণে করে দেখা যায়, বাংলাদেশের জাতীয় বায়ুমানের মানদন্ড (৩৫ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটার) পূরণ করা সম্ভব হলেও তা বড় প্রভাব ফেলতে পারে। এতে মৃত্যুহার ১৯ শতাংশ, আয়ুষ্কাল জনিত সমস্যা ২১ শতাংশ এবং অক্ষমতার সাথে বসবাস করা বছর ১২ শতাংশ কমতে পারে। এ ছাড়া ডব্লিউএইচও-এর ২০২১ সালের কঠোর নির্দেশিকা বায়ুর মান প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম অর্জন করা সম্ভব হলে মৃত্যুহার ৭৯ শতাং হ্রাস পাবে। যা প্রতি বছর ৮১ হাজার ২৮২ মানুষের জীবন রক্ষা করবে। সেইসঙ্গে হাঁপানি-শ্বাসকষ্ট প্রায় সমস্ত জরুরি চিকিৎসক ভিজিট, অকাল প্রসব এবং বার্ষিক ২৬৩ মিলিয়ন কর্মদিবস অসুস্থতাজনিত ছুটি এড়ানো যাবে।
প্রতিবেদনের সুপারিশ অংশে বলা হয়, পরিবেশ সুরক্ষায় বাংলাদেশকে নিজস্ব জাতীয় নির্দেশিকা মেনে চলার পাশাপাশি তা প্রয়োগ করতে হবে। মাঝারি মেয়াদে ২০০৫ সালে ডব্লিউএইচও এর নির্দেশিকা প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ১০ মাইক্রোগ্রামের দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হিসাবে ২০২১ সালের ডব্লিউএইচও নির্দেশিকা প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম অর্জন করা উচিত। সুপারিশে আরও বলা হয়, কয়লা ও ডিজেলের মত কার্বণ নিঃসরণকারী জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দীর্ঘমেয়াদে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসাহিত করা উচিত। এছাড়া ক্লিন পরিবহন ব্যবস্থা ও শিল্প সম্প্রসারণ দীর্ঘমেয়াদে নিয়ন্ত্রণে রাখতে অপরিহার্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
এ বিষয়ে সিআরইএ এর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশ্লেষক ড্যানিয়েল নেসান বলেন, বিভিন্ন বায়ু মানের মানদন্ড, বাংলাদেশের বর্তমান মান এবং ২০০৫ ও ২০২১ সালের ডব্লিউএইচও এর নির্দেশিকা তুলনা করে দেখা গেছে যে, পিএম ২.৫ স্তরে সামান্য উন্নতিও জাতীয় পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য সুবিধা এনে দিতে পারে।
এ বিষয়ে সিআরইএ এর বায়ু মান বিশ্লেষক ড. জেমি কেলি বলেন, বাংলাদেশের বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার অপরিণত শিশু, কম ওজনের শিশুর জন্ম এবং শিশু মৃত্যু ঘটছে। এই পরিস্থিতি এমন হস্তক্ষেপের জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে, যা সবচেয়ে অরক্ষিতদের সুরক্ষা দিতে সক্ষম। দূষণ প্রতি বছর প্রায় ২৬৬ মিলিয়ন কর্মদিবসের ক্ষতি সৃষ্টি করে, যা উৎপাদনশীলতার বড় ধরনের ক্ষতি করে ব্যবসা ও পরিবারের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করে দেয়।
এ বিষয়ে ক্যাপস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে গিয়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তা শুধু মানুষের শরীরেই প্রভাব ফেলছে না, বরং বিপর্যস্ত করে তুলছে মানসিক স্বাস্থ্যকেও।
গত বছরের জুনে সিঙ্গাপুরের নানিয়াং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনটিইউ) এক গবেষণায় বায়ুদূষণের ভয়াবহতার কথা তুলে ধরা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ুদূষণের কারণে ১৯৮০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বে প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি মানুষের অকাল মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য অর্থায়ন কোনো সমস্যা নয়। বরং সঠিক পদক্ষেপের অভাবই মূল সমস্যা। ২০১৯ সালে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ছিল ২০২৫ সালের মধ্যে মাটির ইট ব্যবহার পর্যায়ক্রমে পুরোপুরি বন্ধ করা। কিন্তু ওই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২০২৫ সালের পরিবর্তে ২০২৮ সাল পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে। জানা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ' বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তান ২০৩০ সালের মধ্যে বার্ষিক গড় পিএম ২.৫ থেকে ৩৫ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটারে নামিয়ে আনতে সম্মত হয়েছে।