প্রতিনিয়তই রাজধানী ঢাকার বাতাস দূষিত হয়ে উঠছে। বছর বছর এটি ক্রমেই ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে। বিশেষ করে শীত মৌসুম এলে বাংলাদেশে দূষণস্তর খারাপ থাকে। চলতি বছর শীতের মধ্যেও টানা কয়েক সপ্তাহ ঢাকার বাতাসের মান ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় টানা কয়েক দিন ধরেই ঢাকায় বইছে খুব ‘অস্বাস্থ্যকর’ বাতাস। গতকাল শুক্রবারও ছিল একই অবস্থা। এদিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আন্তর্জাতিক বায়ুমান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার বায়ুদূষণের তালিকা প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, বিশ্বের ১২২ নগরীর মধ্যে শুক্রবার সকালে বায়ুদূষণে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে জনবহুল নগরী ঢাকা। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আইকিউ এয়ারের মানসূচকে ঢাকার বায়ুর মান ছিল ২১৯। বায়ুর এই মানকে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শুক্রবার বিশ্বে বায়ুদূষণে ৩৫২ স্কোর নিয়ে প্রথম অবস্থানে ছিল মিসরের রাজধানী ‘কায়রো’।
বায়ুদূষণের পরিস্থিতি নিয়মিত তুলে ধরে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার। বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা এই লাইভ বা তাৎক্ষণিক সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় ও সতর্ক করে আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি। সেই সতর্কবার্তায় নগরবাসীর উদ্দেশে আইকিউ এয়ারের পরামর্শ, বাসার বাইরে বের হলে সুস্বাস্থ্যের জন্য অবশ্যই মাস্ক পরিধান করতে হবে।
ঢাকায় ছুটির দিনে সাধারণত যানবাহনের চলাচল কম থাকে। তাই এ দিনটিতে কলকারখানার বেশির ভাগ বন্ধ। ঢাকায় বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস হলো এই যানবাহন ও কলকারখানার দূষিত ধোঁয়া। তারপরও ঢাকার বায়ুমান খুব অস্বাস্থ্যকর। আইকিউ এয়ারের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের অন্য বিভাগীয় শহরের মধ্যে চট্টগ্রামের বায়ুর মান ১২২, রাজশাহীতে ১৬৯ আর খুলনায় ১৫৯। ঢাকা ও আশপাশের তিন সর্বোচ্চ দূষিত এলাকার মধ্যে আছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস এলাকা (২৫৩), আগা খান একাডেমি (২৪৭) এবং মহাখালীর আইসিডিডিআরবি ভবন (২২৫)। ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উপাদান হলো বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা বা পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি। ঢাকার বাতাসে এর উপস্থিতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানমাত্রার চেয়ে ২৮ গুণ বেশি। বায়ুদূষণের যে অবস্থা, তা থেকে রক্ষা পেতে আইকিউ এয়ারের পরামর্শ, ঘরের বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক পরিধান করতে হবে। খোলা স্থানে ব্যায়াম করা যাবে না। আরও একটি পরামর্শ, ঘরের জানালা বন্ধ রাখতে হবে।
দূষণ কমানোর কার্যকর পরিকল্পনা নেই :
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বাতাসের মান দিনদিন খারাপ হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করায় পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। বাতাসের মানের একটি প্রধান সূচক হলো বাতাসে পিএম ২.৫ এর পরিমাণ। পিএম অর্থ পার্টিকুলেট ম্যাটার এবং ২.৫ অর্থ এর আকার। পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে, ২০১৮ সাল থেকে, বাতাসে পিএম ২.৫ এর বার্ষিক গড় ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটার ৮৩.২৪ থেকে ১০৪.২০ মাইক্রোগ্রামের মধ্যে রয়েছে। ছোট আকারের কারণে পিএম ২.৫ মানুষের শ্বাসতন্ত্রের গভীরে প্রবেশ করতে পারে এবং সেখান থেকে পুরো শরীরে ছড়িয়ে স্বল্প থেকে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে।
দেশে বায়ুদূষণ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে সম্প্রতি পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন, শীত মৌসুমকে কেন্দ্র করে ঢাকার বায়ু দূষণ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ঢাকার চারপাশের অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করাসহ বায়ু দূষণ রোধের ব্যবস্থা না করে নতুন ভবন নির্মাণের লাইসেন্স দেওয়া হবে না। খোলা ট্রাকে বালু বা ইট বহন করা যাবে না। বায়ুদূষণ মিটিগেশনের ব্যবস্থা না থাকলে নির্মাণ কাজের অনুমতি দেওয়া হবে না বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার এই উদ্যোগ আর নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ে অনেকটা কার্যকরিতা পাচ্ছে না বলে পরিবেশবিদরা অভিযোগ করে আসছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত নগরায়ন, ইটভাটা, জৈবশক্তি পোড়ানো, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ, পুরোনো যানবাহন চলাচল, নিম্নমানের জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এবং আন্তঃসীমান্ত বায়ুর গুণমান বাংলাদেশে বাতাসের মান নিম্ন হওয়ার প্রধান কারণ। এগুলো বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
গত সপ্তাহে যেমন ছিল বায়ুর মান :
গত সপ্তাহের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত রোববার সকালে ঢাকার বায়ুর মান ছিল ৪৫২, পরে তা আরও বেড়েছিল। বায়ুর মান ৩০০-এর বেশি হলেই তাকে দুর্যোগপূর্ণ বলে মনে করা হয়। রোববার ঢাকার দূষিত ১০টি স্থানের প্রতিটির মানই ছিল দুর্যোগপূর্ণ। এর মধ্যে গুলশানের দুটি স্থানের স্কোর ছিল ৭০০-এর ওপর। যদি কোনো অঞ্চলে পরপর ৩ দিন ৩ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বাই রোমান ৩০০-এর বেশি থাকে বা দুর্যোগপূর্ণ থাকে, তবে সেই অঞ্চলে স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করা দরকার বলে মনে করেন পরিবেশবিদেরা। গত ডিসেম্বরের একটি দিনও নির্মল বায়ু পায়নি রাজধানীবাসী।
দূষণসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ক্যাপসের এক জরিপে দেখা গেছে, ডিসেম্বরে যত বায়ুদূষণ ছিল, তা গত ৯ বছরে সর্বোচ্চ। ক্যাপসের গবেষণায় দেখা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বরে বায়ুর গড় মান ছিল ২৮৮। ২০১৬ সালের থেকে এত খারাপ কখনোই হয়নি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বায়ুর মান ছিল ১৯৫। গত ৯ বছরে ডিসেম্বরে ঢাকার বায়ুর মান ছিল ২১৯ দশমিক ৫৪। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এই মান ৩১ ভাগের বেশি বেড়ে গেছে। আর ২০২৩ সালের তুলনায় বেড়েছে ২৬ ভাগের বেশি।
জানা গেছে, ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বায়ু দূষণ মোকাবিলায় বাংলাদেশ ২.৩ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে। দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার কোয়ালিটি ফান্ডিং ২০২৩ অনুসারে, চীন এবং ফিলিপাইনের পরেই বায়ুদূষণ রোধে আন্তর্জাতিক তহবিলের তৃতীয় শীর্ষ গ্রহীতা ছিল বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য অর্থায়ন কোনো সমস্যা নয় বরং সঠিক পদক্ষেপের অভাবই মূল সমস্যা। সূত্র জানিয়েছে, ২০১৯ সালে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ছিল ২০২৫ সালের মধ্যে মাটির ইট ব্যবহার পর্যায়ক্রমে পুরোপুরি বন্ধ করা। কিন্তু ওই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২০২৫ সালের পরিবর্তে ২০২৮ সাল পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তান ২০৩০ সালের মধ্যে বার্ষিক গড় পিএম ২.৫ থেকে ৩৫ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটারে নামিয়ে আনতে সম্মত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ২০২২ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ু দূষণ এবং জনস্বাস্থ্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়, উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাতাসের প্রভাবের কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনার বায়ুদূষণে ৩০ শতাংশ ভূমিকা রাখে ভারত থেকে আসা দূষিত বায়ু। এগুলো বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।