প্রকাশ: রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১১:৫৮ এএম (ভিজিটর : ২৪৯)
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য ঐতিহাসিক এক বছর। পুরো দেশ যেখানে বদলে গেছে আমূলে, সেখানে ক্রীড়াঙ্গনে এর প্রভাব পড়বে সেটাই তো স্বাভাবিক। হয়েছেও তাই। তবে, অন্যান্যদের তুলনায় একটু বেশিই ভুগেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। মাঠ এবং মাঠের বাইরের নানা কারণে দীর্ঘদিন ক্রীড়া অনুরাগীদের মনে থেকে যাবে এর স্মৃতিগুলো। পরিস্কার করে বললে, দেশের ক্রিকেট বোর্ড। এ বছর ১০টি টেস্টের পাশাপাশি বাংলাদেশ ৯টি ওয়ানডে ও ২৪ টি-টোয়েন্টি খেলে। এর বাইরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ তো ছিলোই। এ বছরই দেশের টেস্টের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৩টি টেস্ট জিতে বাংলাদেশ। একসময়কার ওয়ানডেতে সেরা বাংলাদেশ এবছর এ ফরম্যাটে সবচেয়ে ব্যর্থ। মাত্র ৩টি ওডিআই জিতেছে। দুর্বল টি-টোয়েন্টিতে এবার ভালো করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে বাংলাদেশ জিতেছে ১২টি, হারও সমান ১২টিতে। এ বছরই মাঠের বাইরের নানা ঘটনায় আলোচিত ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বিসিবি। যেখানে এসেছেন নতুন একজন সভাপতি। সাকিব আল হাসানের অবসর এবং দেশে ফেরা নিয়েও জলঘোলা হয়েছে অনেক। একজন ক্রিকেটারকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে চাকরি হারান চান্ডিকা হাথুরুসিংহে। ২০২৪ বিপিএলে আলোচনায় সাকিব আল হাসান। সেটাও মাঠের ক্রিকেটে নয়। চোখের সমস্যা ধরা পড়ে অলরাউন্ডারের। ইংল্যান্ড-ভারতে চিকিৎসা করেও সমাধান পাননি। ব্যাটিংয়ে সমস্যা হওয়ায় প্রথমবারের মতো বোলার হিসেবে ম্যাচ খেলেন তিনি। যদিও, সে বিপিএলে শেষ পর্যন্ত মূল আলোচনায় ছিলেন তামিম ইকবাল। তার নেতৃত্বেই যে প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতে ফরচুন বরিশাল। ৪৯২ রান করে টুর্নামেন্ট সেরা হন তামিম। তবে এবছর বিপিএলে সর্বকালের সেরা সাকিব আল হাসানের অভাব অনুভব করবে ক্রিকেটানুরাগীরা। ক্রিকেটে আরও একটি ঘটনা ছিল আলোচনার শীর্ষে। ২০২৩ বিশ্বকাপে বাজে পারফরম্যান্সের তদন্ত রিপোর্ট। যেখানে আলাদা করে ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বলা হয় নাসুমের চড় কান্ড ও তামিমের বাদ পড়া নিয়ে। যদিও, সে রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। তবে, গণমাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়া বিভিন্ন আলোচনা থেকে জানা যায়, সব কিছুর মূলে ছিলেন চান্ডিকা হাথুরুসিংহে।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেরা আটে উঠলেও সেমির টিকিট না পাওয়ায় হতাশ ছিলেন দেশের ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা। এরপরই আসে সে ক্ষণ। যখন বদলে যায় বাংলাদেশ। জুলাই থেকে আগস্ট কোটা আন্দোলন রূপ নেয় ছাত্রজনতার গণআন্দোলনে। যেখানে জনতার বিক্ষোভের মুখে ভূপাতিত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু এই পুরো আন্দোলন চলাকালে সাকিব-মাশরাফির নিরবতা ক্ষুব্ধ করে দেশের ক্রিকেট সমর্থকদের। ৫ আগস্টের পর তারা ব্রাত্য হয়ে পড়েন দেশের ক্রিকেটে। বদলে যায় ক্রিকেট বোর্ডও। সরকারের সঙ্গে পালিয়ে যান বিসিবির প্রেসিডেন্টসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ পরিচালক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর সে জায়গায় আসে নতুন মুখ। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতির দায়িত্বে নেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক এবং সাবেক প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ। পরিচালক হন নাজমুল আবেদীন ফাহিম। বাদ পড়েন জালাল ইউনুস, সাজ্জাদুল আলম ববি। পদত্যাগ করেন খালেদ মাহমুদ সুজন ও নাঈমুর রহমান দুর্জয়রা। কিন্তু এ টানাপোড়েনে বাংলাদেশ হারায় নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্বাগতিক হওয়ার সুযোগ। নিরাপত্তার অভাবে বাংলাদেশে ভ্রমণ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারী দেশ। পরে, বিশ্বকাপ নিয়ে যাওয়া হয় আরব আমিরাতে। যদিও, হোস্ট রাইট রাখা হয় বাংলাদেশের কাছেই। এর মাঝেই বাংলাদেশের পুরুষ ক্রিকেটাররা ঘটায় এক অসম্ভব ঘটনা। প্রথমবারের মতো পাকিস্তানকে তাদের মাটিতে সাদা পোশাকে হোয়াইটওয়াশ করেন শান্ত-মিরাজরা। যার জন্য বিসিবির পাশাপাশি দলকে সংবর্ধনা দেন প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর ভারত সিরিজে গিয়ে অবশ্য সে ফর্মের ধারাবাহিকতা রাখতে পারেনি টাইগাররা। সব ফরম্যাটে হেরে হোয়াইটওয়াশ হন তারা। ভারত সফরে টেস্ট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন সাকিব আল হাসান। জানান দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঘরের মাঠে খেলে অবসর নিতে চান তিনি। টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। তবে, দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ শুরুর আগেই বড় এক ধাক্কা খায় টাইগার ক্রিকেট। চান্ডিকা হাথুরুসিংহেকে কোচের পদ থেকে সরিয়ে দেয় বিসিবি। নাসুমের চড় কান্ডে তাকে শোকজও করে তারা। নতুন কোচ হিসেবে সাবেক উইন্ডিজ ক্রিকেটার ফিল সিমন্সের হাতে তুলে দেয়া হয় শান্তদের দায়িত্ব। কোচ বদলালেও ভাগ্য বদলায়নি টাইগারদের। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজেও ভরাডুবি হয় বাংলাদেশের। কিন্তু সে সিরিজ মানুষ মনে রাখবে সাকিব আল হাসানের জন্য। কারণ, তিনি দেশে আসবেন কি আসবেন না, তা নিয়ে পুরো দুই দিন চলে মেগা সিরিয়াল। শেষ পর্যন্ত দেশে আসা হয়নি তার। শারজায় আফগানিস্তানের কাছে সিরিজ হেরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যায় বাংলাদেশ। সেখানে টেস্ট সিরিজ ড্র করে তাক লাগিয়ে দেয় ক্রিকেট বিশ্বকে। বাংলাদেশের পেস বোলারদের প্রশংসা ঝরে কিংবদন্তিদের মুখে। এরপর ওয়ানডে সিরিজ হারলেও, টি-টোয়েন্টিতে ক্যারিবিয়ানদের হোয়াইটওয়াশ করে বছরটা দারুণভাবে শেষ করে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। এর মাঝে বিসিবিতেও চলে কর্মযজ্ঞ। বিপিএলের আগে এনসিএল টি-টোয়েন্টি আয়োজন করে স্থানীয় ক্রিকেটারদের প্রশংসা কুড়ায় ফারুক আহমেদ বাহিনী। একইসঙ্গে বিপিএলের মাসকট, থিম সং প্রকাশ এবং ভিন্ন ভিন্ন ভেন্যুতে কনসার্টে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের শহীদদের জন্য বিশেষ সম্মাননার ব্যবস্থা করেও প্রশংসিত হয় ক্রিকেট বোর্ড। ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার কাছে টি-টোয়েন্টি সিরিজ হেরে শুরু বছরটা বাংলাদেশ শেষ করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টি-টোয়েন্টি সিরিজে হোয়াইশওয়াশ করে। বছর শেষে খেরোখাতার হিসাব দেখাচ্ছে ৪৩ ম্যাচ খেলে ১৮ জয় বাংলাদেশের, হার ২৫টিতে। ব্যাট-বলে দারুণ এক বছর কাটিয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। টেস্টে দুই বিভাগেই সবার ওপরে তার নাম। টি-টোয়েন্টিতে রেকর্ড গড়েছেন রিশাদ। ক্যারিয়ারের এক-চতুর্থাংশ উইকেটই তাসকিন আহমেদ পেয়েছেন এ বছর। হৃদয়-জাকেরের ব্যাট সারা বছরই আলো ছড়িয়েছে। বছরের শুরুতে টেস্টে অলরাউন্ডার র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ দশেও ছিলেন না মেহেদী হাসান মিরাজ। বছরের শেষ প্রান্তে এসে সেই মিরাজ এখন টেস্টে র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা অলরাউন্ডার। ব্যাট হাতে ৬১৪ রান করা মিরাজ বোলিংয়ে নিয়েছেন ৩১ উইকেট। বোলিংয়ে হাসান মাহমুদের সঙ্গে জমজমাট লড়াই হয়েছে মিরাজের। ৩০ উইকেটে এক পঞ্জিকাবর্ষে বাংলাদেশের পেসারদের রেকর্ড গড়েও হাসান দ্বিতীয় হয়েই বছর শেষ করেন। ব্যাটিংয়ে মিরাজের পরেই আছেন মুমিনুল হক। বছরে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের তিন সেঞ্চুরির একটি এসেছে তার ব্যাট থেকেই। এ বছর মাত্র ৯টি ওয়ানডেই খেলেছে বাংলাদেশ। সেই নয় ম্যাচে সবচেয়ে বেশি রান করেছেন মাহমুদউল্লাহ। ২০২৪ এ মাহমুদউল্লাহর ৩৩৭ রানের ২৯৪-ই এসেছে শেষ চার ম্যাচে। বোলিংয়ে ৭ ম্যাচ খেলে সর্বোচ্চ ১৪ উইকেট নিয়েছেন তাসকিন। মাত্র ৪ ম্যাচ খেলেই ১০ উইকেট নিয়ে দুইয়ে মুস্তাফিজ। চোটের কারণে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বছরের শেষ সিরিজটায় ছিলেন তাওহিদ হৃদয়। তাতে অবশ্য কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি হয়নি। এর আগেই ২০ ম্যাচে ৪৯৩ রান করা হৃদয়ই এ বছর ব্যাট হাতে ২০ ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান। ২১টি ছক্কা মেরে জাকের আলীর সঙ্গে ছক্কার রেকর্ডটা ভাগাভাগি করছেন হৃদয়। টি-টোয়েন্টিতে রিশাদ হোসেনই বাংলাদেশে হয়ে সর্বোচ্চ ৩৫টি উইকেট নিয়েছেন। তাতে রেকর্ডও হয়ে গেছে। এক পঞ্জিকাবর্ষে বাংলাদেশের হয়ে আরও কোনো বোলার এই সংস্করণে ৩০টির বেশি উইকেট নিতে পারেননি। ৩০ উইকেট নেওয়ার উদাহরণটাও এ বছরই করেছেন তাসকিন। রিশাদ-তাসকিনরা পেছনে ফেলেন ২০২১ সালের মুস্তাফিজুর রহমানকে (২৮)। এ বছর তিন সংস্করণ মিলিয়ে বাংলাদেশের হয়ে হাজার রানের বেশি করেছেন শুধু মেহেদী হাসান মিরাজ। বোলিংয়ে বিপ্লবই ঘটিয়েছেন তাসকিন আহমেদ। ১০ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ২৪০ উইকেট নেওয়া তাসকিন এ বছরই নিয়েছেন ৬৩ উইকেট। এ পঞ্জিকাবর্ষে বাংলাদেশের হয়ে এর চেয়ে বেশি উইকেট নিতে পেরেছেন মাত্র একজনই,সাকিব আল হাসান। ২০১০ সালে তিন সংস্করণ মিলিয়ে ৭৭ উইকেট নিয়েছিলেন সাকিব। ২০২৪ সালের আগে বাংলাদেশের পেসাররা টেস্টে স্পিনারদের চেয়ে বেশি উইকেট পেয়েছিলেন ২০০৭ সালে। এ বছর স্পিনাররা পেসারদের চেয়ে ১৩ উইকেট পেছনে। পেসারদের উইকেট ৮২, স্পিনারদের ৬৯।
এবার পেসারদের দাপটের বছরে সর্বোচ্চ ৩০ উইকেট ৯ ম্যাচ খেলা হাসান মাহমুদের, যা টেস্টে বাংলাদেশের কোনো পেসারের সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ড। হাসান পেছনে ফেলেছেন শাহাদাত হোসেনকে। বছরের শেষে এসে টি-টোয়েন্টিতে আরেকটা রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ।
সেন্ট ভিনসেন্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করার পথে ৩০ উইকেট নিয়ে বিশ্ব রেকর্ডও করে বাংলাদেশ। তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে এর আগে কোনো দল প্রতিপক্ষকে তিনবার অলআউট করতে পারেনি। বাংলাদেশের নারীরা এ বছর ছয়টি ওয়ানডে খেলে তিনটিতে জিতেছে, সমান তিনটিতে হার। এরপর অবশ্য সিলেটে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয় বাংলাদেশের নারীরা। এছাড়া মার্চে অস্ট্রেলিয়ার কাছে তিন ম্যাচের হোম সিরিজে সবগুলোতেই হেরেছে নিগার ও তার দল। এ বছর ১৯টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে নিগাররা জিতেছে মাত্র তিনটি! অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৩-০ তে, ভারতের কাছে ৫-০ তে ও আয়ারল্যান্ডের কাছে ৩-০ তে সিরিজ হেরেছে ঘরের মাঠে। এ বছর আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডকে হারালেও পরে টানা তিন ম্যাচ হেরে বিদায় নেয় নিগারের দল।