দ্রব্যমূল্যের বাড়তি দাম। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোয় নগদ টাকার সংকট। এতে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। মূল্যস্ফীতির প্রভাবে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় মানুষের কেনাকাটা কমেছে; যা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কোনোভাবেই নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার। নানাভাবে ব্যবসায়ীদের চাপে রেখে নিত্যপণ্যের শুল্ক প্রত্যাহারের ভ্রান্তনীতি অনুসরণ করছে। সে কারণেই শুল্কছাড়ের সুবিধা ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এটা বড় উদ্বেগের বিষয়। সবকিছুর দাম বাড়ায় স্বল্প আয়ের মানুষ কষ্টে আছে। তারা মধ্যবিত্তকেও এখন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার কথা বলেছেন। সরকার নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ভর্তুকি মূল্যে খোলাবাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করলে নিম্নআয়ের মানুষ স্বস্তি পেতে পারে। এছাড়া সরকার আমদানিনির্ভর পণ্যগুলোতে শুল্ক কমালে আমদানি ব্যয় কমবে। তাহলে হয়তো কিছুটা স্বস্তিদায়ক মূল্যে পণ্যগুলো বাজারে পাওয়া যেতে পারে। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূইয়া বলেন, মানুষ এখন অনেক কষ্টে আছে। দিনদিন এসব সমস্যা প্রকট হচ্ছে। সরকার বিভিন্ন পণ্যের শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। এর পরও দাম কমেনি। সবজির দাম কিছুটা কমলেও ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসেনি। এ সময়ে চালের দাম বাড়ার কথা নয়। অথচ চালের দাম অত্যধিক বেড়েছে। এছাড়া পিঁয়াজ-আলুর দাম কমেনি। টিসিবির ট্রাক সেলে কিছু কিছু লোক পণ্য পায়, বহু মানুষ পায় না। সার্বিকভাবে বলতে গেলে ভোক্তারা সীমাহীন কষ্টে আছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) সম্প্রতি তাদের এক গবেষণায় জানিয়েছে, দেশে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন, শিগিগরই সমাধানের লক্ষণ নেই। পাশাপাশি অনেকেই খাদ্য ব্যয় কমিয়ে আনতে খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছেন মাছ, মাংসসহ বিভিন্ন আমিষ। সংস্থাটি বলেছে, বর্তমানে রাজধানীতে বসবাসরত চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসে খাদ্য ব্যয় ২২ হাজার ৪২১ টাকা। মাছ-মাংস বাদ দিলেও খাদ্যের পেছনে ব্যয় হবে ৯ হাজার ৫৯ টাকা।
এমন অবস্থায় কষ্টে আছে মানুষ। যেসব ব্যবসায়ী নিত্যপণ্য আমদানি করে তাদের ব্যবসা প্রায় বন্ধ। সরকারের ভ্রান্তনীতির কারণে নানামুখী চাপে ব্যবসায়ীরা। সরকারের একমাত্র বাণিজ্যপ্রতিষ্ঠান টিসিবির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে চাল, খেজুর, তেল, চিনি, পিঁয়াজ, আলু ও ডিম আমদানিতে লোকদেখানো শুল্কছাড় দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু ডিমের দাম কমলেও বাকি ছয় পণ্যের দাম কমেনি আশানুরূপ। কমার বদলে উল্টো বেড়েছে কোনো কোনোটির দাম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি এবং শুল্কছাড়ের পণ্য এখনো দেশে আসেনি তাই দাম কমছে না। যদিও এটি পুরোপুরি সত্য নয়। এদিকে অনেক ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলতে পারছে না গ্রাহক। নিজের জমানো টাকা তুলতে গেলেও গ্রাহককে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। শুধু নগদ টাকাই নয়, আরটিজিএস ও বিএফটিএনের মাধ্যমে লেনদেনের ক্ষেত্রেও জটিলতা দেখা দিচ্ছে টাকার অভাবে।
বাজারে গিয়ে রীতিমতো হোঁচট খেলেন একটি গার্মেন্টস কারখানার ব্যবস্থাপক পদে চাকরি করা আমজাদ হোসেন। এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর কাওরান বাজারে গিয়ে তিনি দেখলেন চাল, মসুর ডাল থেকে শুরু করে আটা, ময়দা, পেঁয়াজ, ভোজ্য তেল ও চিনি সবকিছুর দামই বাড়তি। বাজার করার জন্য হিসাব করে যে টাকা নিয়ে এসেছেন তিনি, তা দিয়ে তার কাছে থাকা তালিকার সব পণ্য কেনা যাবে না। পরে তিনি সেই তালিকা কাটছাঁট করে অতি জরুরি পণ্যগুলো কিনলেন। পরে অনেকটা হতাশা নিয়ে তিনি বলেন, আমাদের মতো চাকরিজীবীদের তো আয় বাড়েনি। কিন্তু বিভিন্ন পণ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে তো আর কুলিয়ে উঠতে পারছি না। শুধু আমজাদ হোসেন নয়, তার মতো স্বল্প আয়ের মানুষেরা কেউই আজ ভালো নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে শুধু খাদ্যপণ্যই নয়, খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের দামও বেড়েছে লাগামহীনভাবে।
গবেষণা বলছে, সমাজে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েছে। একশ জনের অধিকার তছরুফ করে, দু’/এক জনের শতকোটি টাকার মালিক হবার অসম, নিষ্ঠুর, অমানবিক হিংস্র প্রতিযোগিতা চলছে। এসব মাথাপিছু আয়ের হিসাব সাধারণ জনগণের কাছে অকার্যকর ও কষ্টদায়ক। গরীব আর মধ্যবৃত্তরা উপলব্ধি করছে জীবন কত কষ্টের। শতজনের সুখ কেড়ে নিয়ে দু’চার জন তার সুখ একশ গুণ বাড়াতে পারে। কিন্তু তাতে কমে যায় সুখীর সংখ্যা। মধ্যম ও নিম্নবিত্তরা কি খেয়ে পরিবার নিয়ে দিন কাটাচ্ছে খোঁজ নিলে মাথাপিছু আয় নিয়ে আর নাচানাচি থাকবে না। ওষুধ, ডাক্তার, চাল, ডাল, পেয়াজ, সয়াবিন তেল কিনতে গিয়ে গরিব হচ্ছে মানুষ, আর বিগত সরকারের ভুল পরিসংখ্যানে বিভ্রম নিয়ে বিভর রাখা হয়েছিল মানুষদের। মাথাপিছু যে আয় বেড়েছে তা চোখে দেখা যায় না, তবে মাথার ওপর যে ব্যায় চেপেছে তা কারো অদেখা নয়। মাথাপিছু ব্যায় কত বেড়েছে, মাথাপিছু ঋণ কতো, সেটাও পরিসংখ্যানে আনতে হবে।
মাথাপিছু আয়ের হিসাবের সাথে জনগণের অভাব-অনটনের হিসাবের আকাশ-পাতাল ফারাক। ধনীদের মাথাপিছু আয় যদি আলাদাভাবে প্রকাশ করা হতো তাহলে প্রকৃত চিত্র ধরা পড়তো। টাকার এই রোবোটিক হিসাবের নির্মম সত্য হল, কেউ খেয়ে দেয়ে, উপভোগ করে রেখে যায় তার অদেখা ১৪ পুরুষের জন্য! আর কেউ তার শিশু সন্তানকে খেতে দিতে পারে না। তথ্যমতে, বর্তমানে একজন শ্রমজীবী, কাজের বুয়া, গার্মেন্ট ও কারখানার কর্মী, পরিবহন শ্রমিক, দোকান কর্মচারী, বেসরকারী বা প্রাইভেট চাকরিজীবী, নন এমপিও শিক্ষকদের আর্থিক অবস্থা খুবই শোচনীয়। দেশের পরিসংখ্যানে অর্থনীতি সচল, কিন্তু মধ্যবিত্তরা অচল। মাথাপিছু আয় বাড়ানোর চেয়ে দ্রব্যমূল্যের দাম কমালে অচল মানুষ সচল হতে পারে।