প্রকাশ: বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১১:২৫ এএম (ভিজিটর : ১১৭)
রাজনৈতিক পালাবদলের ধাক্কা লেগেছে উন্নয়ন কর্মকান্ডে। কয়েক বছরের মধ্যে দেশে উন্নয়ন প্রকল্পে বৈদেশিক অর্থায়ন কাটছাঁটে এবার রেকর্ড হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগীরাও একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। ফলে প্রকল্পের কম বাস্তবায়ন এবং অর্থছাড়ও কম হচ্ছে। অধিকাংশ প্রকল্প বাস্তবায়নে নেই গতি। পাশাপাশি সরকারও ব্যয় সংকোচনের নীতিতে হাঁটছে। এরই মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য কমিয়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে বাস্তবতা বিবেচনায় সংশোধিত এডিপিতে বড় অঙ্কের বরাদ্দ কমার শঙ্কা তো থেকেই যায়। এর ফলে চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে বৈদেশিক সহায়তার কাটছাঁটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে এবার বেশি টাকার বরাদ্দই বাদ দিতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চাওয়া হচ্ছে বৈদেশিক ঋণ বা অনুদান আছে; এমন প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাড়িয়ে ডলার সংগ্রহ বৃদ্ধি করা।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বলছে, গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থছাড় করেছে ২৫ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছাড়ের পরিমাণ ছিল ৩৬২ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। তুলনামূলক হিসাব করলে দেখা যায়, এ অর্থবছরের চার মাসে ৩৩৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার কম ছাড় হয়েছে। এদিকে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) বলছে, গত চার মাসে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো বৈদেশিক সহায়তা অংশের খরচ করতে পেরেছে ৮ হাজার ২১০ কোটি টাকা বা মোট বরাদ্দের ৮ দশমিক ২১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে খরচ হয়েছিল ১১ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা বা ওই সময়ের বরাদ্দের ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। গত কয়েক বছরের তুলনায় চার মাসে অনেক কম অর্থ খরচ হয়েছে। ইআরডি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কোনো অর্থবছরই মূল এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তা ব্যয়ের লক্ষ্য ঠিক থাকেনি। পরবর্তী সময়ে অর্থবছরের ৬ মাস যেতে না যেতেই বড় অঙ্কের বরাদ্দ ছেঁটে ফেলতে হয়। তবে এক্ষেত্রে গত ২০২২-২৩ অর্থবছর কমেছে ১৭ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে কাটছাঁট করা হয়েছিল ১৫ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। এ অর্থবছরে মোট বরাদ্দ ছিল ৯৯ হাজার ২৪ কোটি টাকা। সেখান থেকে বরাদ্দ কমিয়ে সংশোধিত বরাদ্দ ধরা হয় ৭২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দ কমানোর রেকর্ড তৈরি হয়।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তা অংশে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকা। যা মোট এডিপির ৩৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর থেকে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বাদ দিয়ে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ দাঁড়াতে পারে ৮০ হাজার কোটি টাকা। এর আগে গত ৩১ অক্টোবর চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ এবং আগামী ২০২৫-২৬ এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরের জন্য বরাদ্দের প্রক্ষেপণ দিতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কাছে চিঠি দেয় ইআরডি। সেখানে বলা হয়, বৈদেশিক সহায়তাযুক্ত প্রকল্পগুলোর অগ্রগতির ভিত্তিতে বরাদ্দ নির্ধারণ করে চাহিদা পত্র জমা দিতে হবে। এরই মধ্যে প্রকল্পভিত্তিক বরাদ্দ জমা দিয়েছে অধিকাংশ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এতে মনে করা হচ্ছে; এবার বেশি অঙ্কের বরাদ্দ কমতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি না এলে বৈদেশিক অর্থ ছাড় করে না উন্নয়ন সহযোগীরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে একদিকে অর্থপ্রাপ্তি কমবে; অপরদিকে ঋণ পরিশোধ বাড়তে থাকলে অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া বৈদেশিক অর্থ খরচের ক্ষেত্রে ৮৬ ধরনের প্রতিবন্ধকতা বিরাজ করছে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক-এডিবিসহ অন্য দাতাদের কাছ থেকে ঋণসহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কৃষি, শিল্প ও সমন্বয় উইং) মো. ছায়েদুজ্জামান জানান, সংশোধিত এডিপিতে বৈদেশিক ঋণ কমলেও কমছে না সরকারি অর্থের পরিমাণ। দেশীয় অর্থ ঠিক থাকলেও বৈদেশিক ঋণ সহায়তার অর্থ খরচ কেন কমছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিদেশি অর্থ খরচের নানা নিয়ম কানুন আছে। আমরা কোনো প্রকল্প বিশ্বব্যাংকের ঋণে যখন বাস্তবায়ন করবো; তখন বিশ্বব্যাংকের নিয়মনীতি মেনে কাজ করতে হবে। তাদের পরামর্শক যেভাবে বলবেন সেইভাবে করতে হবে। কিন্তু দেশীয় অর্থ খরচের ব্যাপারে এমনটা হয় না। দেশীয় আইন কানুন মেনে হয়। প্রকল্প পরিচালকদের বৈদেশিক ঋণের বিষয় বুঝতেও সময় লাগে। মূলত এসব কারণে বৈদেশিক ঋণ কমলেও সংশোধিত এডিপিতে ঠিক থাকছে সরকারি অংশ। অর্থবছর শুরুর আগেই বিভিন্ন প্রকল্পের অনুকূলে বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ বাড়িয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু পরে বাস্তবায়ন পর্যায়ে দেখা দেয় নানা জটিলতা। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- সঠিক সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া প্রকল্প গ্রহণ, প্রকল্প তৈরিতেই দুর্বলতা এবং দক্ষতার অভাব। প্রতি বছরই বৈদেশিক বরাদ্দ কমানোর একটা প্রবণতা থাকে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এতো বেশি হারে কমানো হয়নি। গত বছর সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছিল। অর্থাৎ এ বছর গত অর্থবছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি কমছে।
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, নানা কারণে বৈদেশিক ঋণ কমেছে সংশোধিত এডিপিতে। কারণ বৈদেশিক ঋণের টাকা খরচে ওই সংস্থার নিয়ম নীতি মানতে হয়। এছাড়া বৈদেশিক পরামর্শকের মতামত নিতে হয়। প্রকল্প অনুমোদন ও অর্থছাড়ের বিষয়ে বিদেশি সংস্থার মতামত নিতে হয়। অনেক সময় উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে পৌঁছাতে সময়ক্ষেপণ করতে হয়। কিন্তু দেশীয় অর্থ খরচে দেশীয় নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়। প্রকল্প পরিচালকেরা দেশীয় নিয়ম নীতি বেশি জানেন। তবে উন্নয়ন সহযোগীদের নানা ধরনের নিয়মনীতি থাকে। যা অনেক সময় বুঝতে পারেন না প্রকল্প পরিচালকরা। এসব কারণেই মূলত দেশীয় অর্থ খরচ বেশি হলেও সেইভাবে বৈদেশিক অর্থ খরচ করা যায় না।