সরকারি কিংবা ব্যক্তিগত, অথবা গণপরিবহন নির্বিশেষে আইনের তোয়াক্কা না করেই সড়কে চলছে যন্ত্রযান। রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে মামলা, জরিমানা, ডাম্পিং, রেকারিং নিত্যদিনে ট্রাফিক পুলিশের স্বাভাবিক চলমান তৎপরতা। তারপরও সড়কের শৃঙ্খলা যেন মহানগরীর সোনার হরিণ। যানবাহনের চালক কিংবা পথচারীরা কেউ মানছে না ট্রাফিক আইন। যত্রতত্র দাঁড়িয়ে গণপরিবহনে যাত্রী ওঠানামা, ঝুঁঁকিপূর্ণ ওভারটেকিংয়ের দৌরাত্ম্যে সড়ক নিরাপত্তা নাগরিক জীবনের আকাশকুসূম স্বপ্নে পরিনত হয়েছে; অহরহ ঘটছে প্রাণহানি। বিশৃঙ্খলার কারণে সড়কে তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত দীর্ঘ যানজট। এ পরিস্থিতিতে বর্তমানে যানবাহনের গতি নেমে এসেছে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে। বুয়েটের এক গবেষণায় দেখা যায়, সড়কে পিক টাইমে চলাচল করা যানবাহনের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার। ঢাকার সড়কে ঘণ্টায় যানবাহনের গড় গতি ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। যা মানুষের হাঁটার চেয়েও কম। রাজধানীতে যানজটের কারণে প্রতিদিন প্রায় ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। অর্থমূল্যে যা দৈনিক প্রায় ১৩৯ কোটি এবং বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার অধিক। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক বলেন, সড়কে ব্যক্তি মালিকানার পরিবহণ বেশি চলছে। রুট পারমিট যদি নির্দিষ্ট কোম্পানিকে দেওয়া হয় আর উন্নত দেশগুলোর মতো কোনো পরিবহণে ত্রুটি পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়; তাহলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে। বিনিয়োগ ঝুঁঁকির ভয়ে অন্তত কোম্পানিগুলো নিয়ম মেনে চলবে।
রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে প্রতিদিনই দেখা যায় নিয়ম ভাঙার হরেক চিত্র। বিজয় সরণি, ফার্মগেট, বাড্ডা, রামপুরা, বাংলামোটর, মগবাজার, কাকরাইল, কুড়িল, মতিঝিল ও বিশ্বরোডসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টে দেখা গেছে, যানবাহন সিগন্যাল অমান্য করে চলাচল করাটাই যেন স্বাভাবিক নিয়ম। প্রবেশমুখগুলো বন্ধ করে অনিয়ন্ত্রিতভাবে দাঁড়িয়ে থাকছে পাবলিক বাস, ব্যাটারি চালিত রিকশা, রিকশা ও ছোট যানবাহন। প্রধান সড়কে বিক্ষিপ্তভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে বাস-ট্রাক-প্রাইভেট কার। পাশাপশি বিভিন্ন স্থানে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় যাত্রী ছাউনিসহ বাসস্টপ চিহ্নিত করা থাকলেও সে নিয়ম কেউ মানছে না। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে বাস চলাচল করছে ৪২ হাজার ৩৭৮টি। আর সিএনজি চালিত অটোরিকশা চলছে ২০ হাজার ৮৯৩টি। বিশেষ করে এই দুটো পরিবহনকে ব্যবহার করে রাজধানীর মানুষ যাতায়ত করে। এছাড়া মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ার করে কিছু মানুষ যাতায়াত করছে। তবে বাস ও সিএনজি চালিত অটোরিকশা রাজধানীর সড়কে কোনো নিয়মই কেউ মানছে না।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ স্বীকার করছে, মামলা দিয়ে সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মামলা বেড়েছে, উল্টোপথে গাড়ি চলাচল বন্ধ না হলেও কমেছে। কিন্তু যানজট কমছে না, ওভারটেকিং কমছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটা দাগে রাজধানীর সড়কে বিশৃঙ্খলার পেছনে যে কারণগুলো দেখা যায়, সেগুলো হচ্ছে- ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা না থাকা, ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে আইন মানানোর ব্যবস্থা না থাকা, অবৈধ ও লক্কড়ঝক্কড় যানবাহনের দৌরাত্ম্য, ফুটপাত দখল হয়ে যাওয়া, সড়কের খানাখন্দ, অবৈধ পার্কিং ও যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো এবং সেবা দাতা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের অভাব। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও স্রোতার আহ্বায়ক ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, পরিবহন খাতে জবাবদিহি নিশ্চিত না করতে পারায় সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না। পরিবহন খাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার লোকজন, পুলিশ, পরিবহন মালিক, শ্রমিকদের নিয়ে দুর্নীতির দুষ্টু চক্র গড়ে উঠেছে। তারাই পরিবহন খাতে শৃঙ্খলার পথে বড় বাধা। এ অবস্থায় সড়কে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
তিনি জানান, বিগত সরকার সড়ক পরিবহন আইন পাস করলেও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়নি। এ থেকে স্পষ্ট সরকার ও সরকারের কাঠামো পরিবহন খাতের বিভিন্ন দুষ্টু চক্রে বাধা ছিল। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও সরকারের বিভিন্ন পক্ষ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সমন্বয় জরুরি। সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ না করলে সড়কে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব নয়।
যাত্রবাড়ী থেকে টঙ্গী রোডে চলাচলকারী গ্রেট তুরাগ বাসের চালক আব্দুর রহমান বলেন, যাত্রী যেখানে থাকে সেখানেই আমরা বাস থামাই। ফার্মগেটে দাঁড়িয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ মোটরসাইকেল চালকের হেলমেট থাকলেও আরোহীর মাথায় হেলমেট নেই। অনেক মোটরসাইকেল চালক হেলমেটের ভেতরে মোবাইল ফোন গুঁজে কথা বলতে বলতে পথ চলছেন। ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা বলছেন, যেখানে-সেখানে পার্কিং ট্রাফিক সিগন্যাল না মানা; লেন না মেনে এলোমেলো গাড়ি চালানো, পারমিটবিহীন গাড়ির দাপট, এমনকি ট্রাফিক পুলিশের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। তারা জানিয়েছেন, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে তাদের ডিউটি করতে হচ্ছে। অনেকেই নানাভাবে সুযোগ নিয়ে নিয়ম ভাঙছে।
এ বিষয়ে বাংলাদশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, একই শহরে ক্যান্টনমেন্ট এলাকার সড়কে সুশৃঙ্খল চিত্র, অন্য এলাকাগুলোতে ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই আমরা। এর প্রধান কারণ হচ্ছে- অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার আশায় একটি মহল সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে যে কাজগুলো করা উচিত; সেগুলো করছে না। অতীতে দেখা গেছে, যখনই যে রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল, তারাও এই কাজগুলো করেনি। কারণ তাদের নেতা-কর্মীরাই সড়ক থেকে চাঁদাবাজির মাধ্যমে লাভবান হয়েছে। যেহেতু ওই নেতারা প্রভাবশালী, তারা বিভিন্নভাবে পুলিশকে ম্যানেজ করে ফেলত। এজন্য সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবার আগে প্রয়োজন। এরপর রাজউক ও সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। সড়কের যে কোনো উন্নয়নমূলক কাজে রোড প্ল্যানার ও ট্রান্সপোর্ট এক্সপার্টদের যুক্ত করতে হবে।