দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স আসা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে; এতে মজবুদ হচ্ছে অভ্যান্তরীন রিজার্ভ। তাতে গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে দেশে প্রবাসী আয় প্রেরণকারী দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশে প্রবাসী আয় আসা তিন মাসের ব্যবধানে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। জুলাইয়ের পর প্রতি মাসেই দেশটি থেকে প্রবাসী আয় আসা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের করা বিপুল ঋণ পরিশোধের চাপ যখন বাড়ছে; তখন রেডর্ক পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়ে অন্তবর্তী সরকারের পাশে থাকছেন প্রবাসীরা। ফলে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বৈধপথে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ হু হু করে বাড়ছে। জানা যায়, বৈদেশি রেমিট্যান্স পালে যখন ক্রমবর্ধমান উন্নতীর হাওয়ার মধ্যেই আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের তৃতীয় কিস্তি অর্থ ছাড়ের শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি ও চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়ে আলোচনা করতে একটি মিশন আগামী ৪ ডিসেম্বর ঢাকায় আসছেন। বাংলাদেশের প্রকৃত রিজার্ভ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে ব্যাংক খাতে ঋণের সুদহার বাড়লেও মূল্যস্ফীতি এখনো ১০ শতাংশের বেশি। রাজস্ব সংগ্রহের গতিও কম। ভর্তুকির চাপও আছে। খেলাপি ঋণও বেড়ে পৌনে তিন লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। তবে আর্থিক খাত সংস্কারে বহুমুখী কার্যক্রমে হাত দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। যা আইএমএফের দলের সঙ্গে অনুষ্ঠেয় বৈঠকগুলোতে তুলে ধরবে বাংলাদেশ। আইএমএফের মতে, এবারের মিশনটি বেশ বড় হচ্ছে। কমপক্ষে ১০ সদস্যের এই মিশনটি এবার ১৪ দিন ঢাকায় অবস্থান করবে। এবারের মিশনে নেতৃত্ব দেবেন আইএমএফের গবেষণা বিভাগের ডেভেলপমেন্ট ম্যাক্রোইকোনমিকসের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও। মিশনটি নতুন অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের জন্য যে আরও অতিরিক্ত ৩০০ কোটি ডলার চেয়েছে তার বিষয়েও আলোচনা করবে। এর আগে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে আইএমএফের চলমান ঋণ কর্মসূচীর অতিরিক্ত আরও ৩০০ কোটি ডলার অতিরিক্ত সহায়তা চায়। এ বিষয়ে আইএমএফ শুরুতে ইতিবাচক সাড়া দিলেও পরে তা পিছিয়ে যায়। এ বিষয়ে আইএমএফলে বার্ষিক সভার সময়েও সাইড লাইনে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া আইএমএফের সঙ্গে ৪৭০ কোটি ডলারের একটি ঋণ কর্মসূচী চলমান রয়েছে। গত ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি আইএমএফ এটি অনুমোদন করে। ইতিমধ্যে তিনটি কিস্তি ছাড় হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড় হওয়ার কথা। এর আগে তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের সময় যেসব শর্ত বাস্তবায়নের কথা বলেছিল সেগুলো অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হবে। একই সঙ্গে বাড়তি অর্থ সহায়তা দেওয়ার বিষয়টিও পর্যালোচনা করবে। তবে জানতে চাইলে অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করতে আইএমএফের দলটি আগামী ৪ ডিসেম্বর ঢাকায় আসছে। ঋণের তৃতীয় কিস্তি অর্থ ছাড়ের শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি ও চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়ে আলোচনা হবার কথা রয়েছে। মিশনটি নতুন অন্তর্বর্তী সরকার যে আরও অতিরিক্ত ৩০০ কোটি ডলার চেয়েছে তার বিষয়েও আলোচনা করবে। তিনি জানান, মিশনটি ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়ে প্রধান কার্যালয়ে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন। সেই প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করছে চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড় ও বাড়তি সহায়তার বিষয়টি সম্পর্কে জানা যাবে। এর বাইরে তিনি কোনো কথা বলতে চাননি।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, চতুর্থ কিস্তির অর্থ পেতে কোনো সমস্যা হবে না বাংলাদেশের।
তিনি বলেন, দুইবার রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে এমন জায়গায় নামিয়ে আনা হয়েছে; যে এখন আর তা অর্জন করতে কষ্ট হবে না। প্রবাসী আয়ের প্রবাহ (রেমিট্যান্স) ভালো। ফলে কিস্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে রিজার্ভ সংরক্ষণের শর্ত কোনো বাধা হিসেবে আসবে না। জাহিদ হোসেন বলেন, অধিকাংশ ব্যাংকের ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বদল হয়েছে। রেপো হার ৯ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১০ শতাংশ। খেলাপি হওয়ার নিয়মটিও ২০১৯ সালের আগের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর আর্থিক খাত সংস্কারে নানা পদক্ষেপ তো আছেই। আশা করছি- এসব ব্যাপারে আইএমএফের কাছ থেকে সরকার বাহবা পাবে। অর্থ বিভাগের সূত্র জানায়, বিগত চার মাসে রেমিট্যান্স ৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে অবস্থান করছে। অর্থবছরের গত চার মাসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বেড়েছে ২৪ শতাংশ। চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম ২৩ দিনে ১৭২ কোটি ৬৪ লাখ মার্কিন ডলার (১.৭৩ বিলিয়ন) রেমিট্যান্স এসেছে। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২০,৭১৬ কোটি টাকার সমান। সে হিসাবে- প্রতিদিন গড়ে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি ডলার। গত অক্টোবরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২৪০ কোটি ডলার। গত সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৪০ কোটি ডলার। গত দুই মাসে রেমিট্যান্স এসেছে সমান সমান। তবে গত বছরের অক্টোবরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৯৭ কোটি ডলার। গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় গত অক্টোবরে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অক্টোবরে দেশে মোট প্রবাসী আয় এসেছে প্রায় ২৪০ কোটি ডলার। এর মধ্যে একপঞ্চমাংশ বা প্রায় ২১ শতাংশই এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আর একই মাসে মোট প্রবাসী আয়ের পৌনে ১৪ শতাংশ এসেছে ইউএই থেকে। সেই হিসাবে অক্টোবরে দেশে আসা মোট প্রবাসী আয়ের ৩৫ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশের বেশি এসেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউএই থেকে। এই দুটি দেশ থেকে অক্টোবরে মোট প্রবাসী আয় এসেছে ৮৩ কোটি ডলার। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রবাসীরা জুলাই মাসে রেমিট্যান্স বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে আগের চেয়ে বেশি গতি বেড়েছে প্রবাসী আয়ে। এতে শক্তিশালী হচ্ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। গত জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন পর ছাত্র-জনতার গণ–আন্দোলনে রূপ নিলে ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়। ক্ষমতার এই পালাবদলে আগস্ট থেকে প্রবাসী আয়ও বাড়তে শুরু করেছে।