মার্চ মাস। ঢাকার রেসকোর্স ময়দান। ১৯৭১ সালে অগনিত মানুষের সামনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষনে বললেন, ‘তোমাদের যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থেক’। তিনি আরো বললেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’। পরিশেষে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’। গর্জে উঠলো বাঙালী জাতি। সারা দেশে স্বাধীনতাকামী দামাল ছেলেরা নিতে শুরু করলো যুদ্ধের প্রশিক্ষণ। ১৯৭১ সালের মার্চে ঈশ্বরদীতে যেসব জায়গায় প্রশিক্ষণ দেয়া হতো, প্রশিক্ষণ লাভকারীদের নাম ও জায়গার বিবরণ নীচে উল্লেখ করা হলো। হলো। প্রায় ৫৪ বছর পূর্বের ইতিহাস, তাই ভুলত্রুটি মার্জনীয়। ঈশ্বরদীতে এই ঈদগাহ মাঠে, প্রথম স্বাধীনতাকামীদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল বাঁশের লাঠি, কাঠের রাইফেল ইত্যাদি। প্রশিক্ষণ লাভকারীদের সংখ্যা ছিল ২৭ জন। তন্মদ্ধ মনোয়ারুল ইসলাম (মংলা ভাই), গোলাম রাব্বানী, হারুনুর রশিদ (ঈশ্বরদী কলেজ ছাত্র সংসদের সদস্য), আব্দুস সামাদ (পাবনা) প্রমুখ। ট্রেনিং কমান্ডার ছিলেন আব্দুর রউফ। তিনি ছিলেন রেলওয়ে পুলিশ। তার রাইফেল ছিল। তিনি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ দিতেন। এই বীর স্বাধীনতা যোদ্ধাকে পাকিস্তানী আর্মিরা গুলী করে হত্যা করে।
এই মাঠটিকে বলা হয় ঐতিহাসিক মাঠ। এই মাঠে জেনারেল আইয়ুব, ফাতেমা জিন্নাহ্, মওলানা ভাসানী, শেখ হাসিনা, জিয়াউর রহমান প্রমুখ ভাষন দিয়েছেন। এই মাঠে যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তারা ছিলেন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য। যারা ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন, তারা হলেন: মতিউর রহমান কচি, গোলাম মোস্তফা বাচ্চু, পিএম আজাদ, শামছুল আনোয়ার মুকুল, নিলু পান্ডে, আব্দুল বারী ও মনছুর (জয়পুর হাট), আমিনুর রহমান দাদু, আনোয়ার রশিদ রন্জু (কৌতুক অভিনেতা), আব্দুল হাই সিদ্দীক (সাবেক ডাইরেক্টর এন এস আই), শওকত হোসেন কেল্টু, আব্দুল খালেক রবি (সাবেক কমিশনার), আব্দুর রাজ্জাক গেদন, আব্দুস সামাদ মজনু।। আব্দুল আজীজ সিদ্দীক, হাবিবুর রহমান হবি প্রমুখ। এই স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের আজ প্রায় সবাই মৃত।
ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন প্রয়াত জসীম উদ্দীন মন্ডল (জসীম চাচা)। তিনি সুুবক্তা ও সাদা মনের মানুষ হিসাবে সারা বাংলাদেশে সুখ্যাতি লাভ করেন। জসীম চাচার সাথে আমারও ছিল চমৎকার সম্পর্ক। সেই সময় জসীম বাড়ী ছিল ক্যাম্প । জসীম চাচার নেতৃত্বে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যরা প্রশিক্ষনের জন্য যেত সাঁড়া মাড়োয়ারী হাই স্কুল মাঠে। তারা হলেন: শরীফ সরোয়ার্দ্দী বিশু, মাহাবুবুর রহমান (মাহাবুব), হাশেম সারোয়ার, মুক্তার হোসেন ভাল্টু (সাবেক কমিশনার) কামাল আহমেদ, শামছুজ্জামান সেলিম, ফজলুর রহমান ফান্টু, শহীদুজ্জামান নাসিম, বিলকিস রহমান বিলু, শেলী, মিনা, আলো প্রমুখ।
ঈশ্বরদী কলেজ মাঠে যারা প্রশিক্ষণ নিতেন, তাদের মধ্যে অন্যতম: প্রয়াত আব্দুর রহিম মালিথা ও ইদ্রিস আলী মালিথা (দুই ভাই), নূরুজজামান বিশ্বাস (সাবেক সংসদ সদস্য), শাহাবুদ্দীন সরদার (সাবান সরদার) প্রমুখ।
উত্তাল মার্চে এই মাঠেও প্রশিক্ষণ হতো, এখানে যারা প্রশিক্ষণ নিতেন, তাদের মাত্র একজনের নাম আমি সংগ্রহ করতে পেরেছি। তিনি হলেন, তারিকুল ইসলাম, ফারুখ।
পাকশীতে যারা প্রশিক্ষণ নিতেন, তাদের মধ্যে অন্যতম: সিরাজুল ইসলাম মন্টু, আমিনুল ইসলাম চুন্নু, কাজী সদরুল হক সুধা, সৈয়দ জাফর সাজ্জাদ খিচ্চু, বাবুল সরদার, সিরাজুল ইসলাম সরদার (সাবেক সংসদ সদস্য), আজাদ আলী বিশ্বাস। আব্দুল খালেক, রশিদুল্লাহ, আবুল বাশার, ফজলুর হক প্রমুখ।
১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে ঈশ্বরদীতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। যা অনেকের কাছে অজানা।
আব্দুল মান্নান সরদার। তিনি জীবিত এবং ঈশ্বরদীতে বসবাসরত। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চের ভাষন শুনতে তিনি ঢাকার রেসকোর্স মাঠে গিয়েছিলেন। ভাষন শেষে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের কিছু লাল সবুজের পতাকা সংগ্রহ করেন। পতাকাগুলো তিনি ঈশ্বরদীতে নিয়ে আসেন। ঈশ্বরদী পূর্বটেংরী অঞ্চলে স্বাধীন বাংলাদেশের এই পতাকাগুলো প্রথম উত্তোলিত হয়েছিল।
জনতা টেইলার্স, ঈশ্বরদী বাজার। এটি আমাদের পৈত্রিক দোকান। তখন টেলারিংয়ের কাজ করতেন, আমার বড় ভাই আব্দুল আজীজ সিদ্দীক। তাকে স্বাধীনতাকামীরা বলল, লাল সবুজের পতাকা বানাতে। রাতের বেলা মোমবাতি জ্বালিয়ে সিদ্দীক ভাই সারারাত জেগে পতাকা বানিয়েছিলেন। সেই পতাকাগুলো উড়ানো হয়, ঈশ্বরদীর পশ্চিম টেংরী এলাকায়। ১১ এপ্রিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঈশ্বরদীতে প্রবেশ করে পতাকাগুলো দেখতে পেয়েছিলেন।
পাকিস্তান আমলে ঘড়ির মেকার হিসাবে ঈশ্বরদীতে অত্যান্ত সুপরিচিত ছিলেন নূরু মেকার। তার ছেলে শহিদুল হক ছিলেন রেডিও মেকার। শহিদুল হক এখনো বেঁচে আছেন। ঈশ্বরদী বাবু পাড়ায় আমাদের বাড়ীর সন্নিকটে শহিদুল হকের বাড়ী। বর্তমানে বৈকালী হোটেলের পাশেই ছিল তাদের দোকান। তখন এই দোকানের সামনেই ছিল সুনীল দাদার চায়ের দোকান। উত্তাল মার্চের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। শহীদল ভাই বিশেষ কৌশলে রেডিও থেকে নিজের কন্ঠস্বর রীলে বা প্রেরন করার চেষ্টা করেন। সেই সময় আকাশ বাণী রেডিও সেন্টার অনেকেই শুনতেন। এই সেন্টারে ভালো গান শোনা যেত। সুনীলদা আমাশ বানী সেন্টার শুনছিলেন। এই সেন্টারে ফ্রিকোয়েন্সী সেট করে পরীক্ষামূলক ভাবে শহিদুল ভাই বললেন, সুনীলদা চা দিয়ে যান। সুনীলদা রেডিওতে শহিদুল ভাইয়ের কন্ঠ শুনে চমকে ওঠেন। তিনি দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে শহিদল ভাইয়ের কাছে আসেন। এই সফলতা থেকে শুরু হয় আরেক চিন্তা। কি করে ৭ মার্চের ভাষন এবং নিজেদের কণ্ঠস্বর সারা ঈশ্বরদী ব্যাপী রীলে করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী এমপ্লিয়ার। আমার ভাই আব্দুর রাজ্জাক গেদনের সাথে শহিদুল ভাইয়ের ছিল বন্ধুত্ব। রাজ্জাক ভাই তখন মাহামুদুর রহমান (যার নামে ঈশ্বরদীতে রহমান কলোনী) এর দোকানে মাইকের কাজ করতেন। মাইকের এমপ্লিফায়ার শক্তিশালী।
শহিদুল ভাই তার পরিকলপনার কথা বললেন রাজ্জাক ভাইকে। ব্যবস্থা হয়ে গেল এমপ্লিফায়ারের। আমাদের বাড়ীর ছাদের উপর তৈরী করা হলো রীলে সেন্টার। এখান থেকে ৭ মার্চের ভাষন এবং স্বাধীনতাকামীদের উদ্দীপ্ত করার গান শোনানো শুরু হয়। যখন ১১ এপ্রিল ঈশ্বরদীতে পাকিস্তানী সেনা বাহিনী প্রবেশ করে, তখনো শহিদল ভাই ও রাজ্জাক ভাই রীলে সেন্টার শক্তিশালী করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। পরে তারা পালিয়ে যায়।
এগুলো সবই ছিল ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ বিশেষ। একটি দেশে স্বাধীন সংগ্রাম একবারই হয়। দ্বিতীয়বার নয়। স্বাধীনতা লাভের শুরু হয় অধিকার আদায়ের বা মুক্তির সংগ্রাম। এটি চলমান প্রক্রিয়া। আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মহা নায়কের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান।
কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় পর্বত দেখি নাই। বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি’। বাংলাদেশের ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। যারা চেষ্টা করছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি। মান্নাদের সেই বিখ্যাত গানটি শোনার জন্য।
‘যদি কাগজে লিখ নাম, কাগজ ছিঁড়ে যাবে, পাথরে লিখ নাম, পাথর ক্ষয়ে যাবে, হৃদয়ে লিখ নাম, সে নাম রয়ে যাবে’।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, হেল কমান্ডো বইয়ের লেখক