দেশে তামাক ব্যবহারজনিত কারণে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ অকালে প্রাণ হারায়। এমন বাস্তবতাকে এড়িয়ে তামাক কোম্পানিগুলো শুধু মুনাফা অর্জনের জন্য আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। তারা রাজস্ব হারানোর কথা বললেও ২০১৮ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক কোম্পানি বছরে যে পরিমাণ রাজস্ব প্রদান করে তার থেকে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা বেশি ব্যয় হয় তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে। তাই দেশের মানুষের সুরক্ষা এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি এড়াতে বিদ্যমান ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩) এখনই ডব্লিউএইচও ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ট্যোবাকো কন্ট্রোল এফসিটিসি’র আলোকে সংশোধন করা প্রয়োজন।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএইচআরএফ) ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ-এর যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন ও তামাক কর বৃদ্ধি: গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে তারা এসব কথা বলেন।
বিএইচআরএফ’র সভাপতি রাশেদ রাব্বীর সঞ্চালনায় সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ-এর প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক খন্দকার আব্দুল আউয়াল রিজভী। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী।
তিনি বলেন, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। কিন্তু তামাক কোম্পানি এবং তাদের পরিচালিত বিভিন্ন সংগঠন আইন সংশোধনের বিরোধিতা করছে। তাদের দাবি, আইন সংশোধন হলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাবে। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য বলছে, ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস হওয়ার পর পরবর্তী ২০০৫-০৬ এবং ২০০৬-০৭ অর্থবছরে সিগারেট খাতে রাজস্ব আয় বেড়েছে যথাক্রমে ১৭.৯৭ শতাংশ এবং ৩৭.৫২ শতাংশ। একইভাবে, ২০১৩ সালের সংশোধনীর পর পরবর্তী ২০১৩-১৪ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সিগারেট খাতে রাজস্ব আয় বেড়েছে যথাক্রমে ২৫.৫১ শতাংশ এবং ৪৬.৫২ শতাংশ। তাই এই অকাল মৃত্যু প্রতিরোধে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী এখনই অধ্যাদেশ আকারে জারি করার দাবি করেন তিনি।
তামাক কোম্পানির আরেকটি দাবি, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। কিন্তু বিষয়টি বাস্তবতা বিবর্জিত। কারণ কোনো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শুধু সিগারেট বিক্রি করেন না। তারা দোকানে কমপক্ষে ৩৮টি পণ্য বিক্রি করেন। তাই একটি পণ্যের বিক্রি বন্ধ হলে তাদের কোনো ক্ষতি হবে না। বরং দেশে ক্ষতিকর এই পণ্যের ব্যবহার কমে আসবে। তাই অবিলম্বে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী এখনই অধ্যাদেশ আকারে জারি করা প্রয়োজন।
ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস্’র (সিটিএফকে) লিড পলিসি অ্যাডভাইজার মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকার বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে তামাক কোম্পানিগুলো বিভিন্ন অপতথ্য ছড়িয়ে আইন সংশোধনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। অধূমপায়ীদের সুরক্ষায় প্রদান এবং নতুন প্রজন্মকে তামাকের ক্ষতিকর দিক থেকে বাঁচাতে প্রস্তাবিত আইন দ্রুত পাস করতে হবে।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক সর্বক্ষেত্রেই তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব লক্ষণীয়। তারপরও দেশে তামাক কোম্পানির ব্যবসা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ দুর্বল আইন। তাই বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী দ্রুত পাস করে অধ্যাদেশ আকারে জারি করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক খন্দকার আব্দুল আউয়াল রিজভী বলেন, তামাক কোম্পানির লক্ষ্য শুধু মুনাফা অর্জন। জনস্বাস্থ্য নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা নেই। একই সাথে তারা ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য নানা কূটকৌশলে কিশোর ও তরুণদের সিগারেট সেবনে উৎসাহী করছে। তাই তাদের কূটকৌশল বন্ধে এবং কিশোর ও তরুণদের সুরক্ষায় বিদ্যমান তামাক আইন সংশোধন করতে হবে।
সেমিনারে অন্যদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের টোব্যাকো নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সমন্বয়ক ডা. অরুনা সরকার ও কমিউনিকেশন অফিসার আবু জাফর, সিটিএফকে’র অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার মো. আতাউর রহমান, প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. আব্দুস সালাম মিয়া ও কমিউনিকেশনস ম্যানেজার হুমায়রা সুলতানা, বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো. মাইনুল হোসেনসহ গণমাধ্যম কর্মীরা।