দিন যতো গড়াচ্ছে রাজধানীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ততো ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে। পাশাপাশি সাধারণ মশার প্রকপও অনেকে বেড়েছে। ফলে মশার বংশ বিস্তার রোধে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। দুই সিটির ২০ টি অঞ্চলে ২০টি টিম তদারকি করার কথা থাকলেও তাদের ঠিকমত মাঠে দেখা যাচ্ছে না বলে নগরবাসী জানিয়েছেন। ফলে ডেঙ্গু নিধনের দুই সিটির উদ্যোগ সফল হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক দুই মেয়র দায়িত্ব থাকাকালীন সময়ে প্রতি অর্থ বছরে ডেঙ্গু নিধনে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হয়। বরাদ্দের কোটি কোটি টাকা খরচ করেও মশা নিধন তারা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে নতুন করে প্রশাসকদের দায়িত্ব দেয়া হলেও একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে। দিন দিন ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠলেও কাজে আসছে না কোনো উদ্যোগ। এমন অবস্থায় ডেঙ্গু নিধন কার্যক্রমে সমন্বিত উদ্যোগের অভাবকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, নতুন প্রশাসক নিযুক্ত হওয়ার পর দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মশকনিধন কার্যক্রম তদারকির জন্য কমিটি করা হয়েছে। তদারকির জন্য বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে দুই সিটির ২০টি অঞ্চলে ২০টি টিম কাজ করছে। এসব টিম মশকনিধন কার্যক্রম চলাকালে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সঙ্গে সমন্বয়ে অঞ্চলের আওতাধীন ওয়ার্ডে মশকনিধন কার্যক্রম তদারকির দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ টিমকে মাঠে দেখা যাচ্ছে না বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। ফলে মশা নিধনের নানা উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে।
সম্প্রতি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক সভায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞগণ মতামত দিয়ে জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাগত তথ্য নয়, রোগীর ঠিকানা অনুসন্ধান করেও ব্যবস্থা নিতে হবে। মশক নিধন স্প্রে শুধুমাত্র নালা-নর্দমায় নয় বাড়ির ভিতরেও ছিটানো প্রয়োজন। সিটি কর্পোরেশনগুলোতে এন্টোমলজি ল্যাব স্থাপন করতে হবে। বিভিন্ন স্থান হতে মশা সংগ্রহ করে প্রজাতি নির্ধারণ করে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে হবে। একই সাথে এলাকাভিত্তিক লার্ভার দৈনন্দিন ঘনত্ব কেমন তা যাচাই-বাছাই করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পরিস্থিতি সামলাতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে দুই সিটিকে। বিশেষ করে ডেঙ্গুর হটস্পট জোন চিহ্নিত করে ব্যাপকভাবে অভিযান চালানোর কোন বিকল্প নেই। না হয় নানা উদ্যোগ নিলেও সুফল মিলছে না বাস্তবে। ওই সভায় জানানো হয়, সারা দেশে এই বছর আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৬৪ হাজার ৪৭১ জন এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৩১৪ জন। গত বছর এই সময়ে ডেঙ্গু সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ১৬৩ জন এবং মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ৩৮০ জন। তবে এরমধ্যে তুলনামূলক ঢাকায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ হলেও নগরবাসী মশার অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছে না। মশা মারায় খরচ বাড়লেও বছরজুড়েই মশার কামড় খাচ্ছে নগরবাসী। মূল কারণ করপোরেশনের গাফিলতি, কার্যকরী ওষুধ ব্যবহার না করা, ঠিকমতো ওষুধ না ছিটানো ও মশার প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করে ধ্বংস করতে না পারা।
জানা গেছে, দুই সিটি করপোরেশনের ১২৯টি ওয়ার্ডে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা। প্রতিদিন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তির সংখ্যাও বাড়ছে। চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলেও মশা নিধনে তেমন কিছুই করতে পারছে না দায়িত্বরত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তাদের মশা নিধনে কোনো পদ্ধতিই কাজে লাগছে না।
দুই সিটির স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, মশা নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি ওয়ার্ডে সারা বছরই নানা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। বর্তমানে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রুপ ধারন করায় মশা নিধনের পাশাপাশি প্রতিদিন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন তারা। নিয়মিত করা হচ্ছে জরিমানাও। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এডিস মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত করার পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে লাখ লাখ টাকা জরিমানাও আদায় করা হচ্ছে। বিশেষ করে প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে মশককর্মীরা ব্যাপকভাবে লার্ভিসাইডিং ও অ্যাডাল্টিসাইডিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। একইসঙ্গে এডিস মশার উৎসমূলগুলো নির্মূলে বিশেষ কার্যক্রমও পরিচালনা করা হচ্ছে।
জানা যায়, চলতি বছরে ঢাকায় দুই সিটি কর্পোরেশনে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত ৩ লাখ ২৬ হাজার ৪৭২ টি স্থাপনা পরিদর্শন করা হয়। যেখানে লার্ভা পাওয়া গেছে ৭ হাজার ১৯৫টি স্থাপন। প্রজনন স্থল ধ্বংস ও লার্ভিসাইড স্প্রে করা হয়েছে ৪ লাখ ১০ হাজার ৩০৭ টি স্থাপনায়। মশক নিধনে স্প্রে করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৫০৫ টি নোভালিউরন ট্যাবলেট প্রয়োগ করা হয়েছে। তবুও কেন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন নগরবাসী এর কোন সঠিক জবাব দিতে পারছে না দুই সিটির সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
নগরবাসীর অভিযোগ, প্রতিবছর নগরীতে এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনা করা হলেও কাজের কাজ তেমন কিছুই হচ্ছে না। তবে কোন বাড়িতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে সেখানে ওষুধ ছিটানোসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু আমরা চাই প্রতিটি এলাকার বাড়িতে এভাবে ওষুধ ছিটানো হোক। তাহলে পুরোপুরি ডেঙ্গুমুক্ত হবে নগরী।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় উপদেষ্টা বলেন, দেশব্যাপী ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে দীর্ঘমেয়াদে গবেষণা এবং উন্নয়নের উপর জোর দিতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকল্পে গঠিত কমিটিতে দেশের স্বনামধন্য কীটতত্ত্ববিদগণকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তারা এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞ। তাদের মতামতের ভিত্তিতেই দেশে ডেঙ্গু মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। ডিএসসিসির প্রশাসক নজরুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমরা নানা কার্যক্রম পরিচালনা করছি। কিন্তু সবাই সচেতন না হলে আমাদের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এডিস মশার উৎসস্থল-গাড়ীর পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের খোসা, মাটির পাত্র, খাবারের প্যাকেট, অব্যবহৃত কমোড উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব পরিত্যক্ত দ্রব্যাদিতে পানি জমে এডিসের লার্ভা জন্মায়। ফলে এসব দ্রব্যাদিতে যাতে পানি জমে না থাকে সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। তাহলে সহজে ডেঙ্গুর প্রকপ কমে যাবে।