১৯৭১ সাল। এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখ। স্থান ঈশ্বরদীর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। মসজিদটি সাপ্তাহিক ঈশ্বরদীর অফিস ও প্রেসক্লাব সংলগ্ন। সকাল বেলা। মসজিদের ভিতর ২৫০ থেকে ৩০০ বাঙালি নারী-পুরুষ প্রাণ রক্ষার্থে আশ্রয় নিয়েছে। পাকশী থেকে দুটো ট্রাক এসে থামল মসজিদের সামনে। ট্রাক দুটোতে ছিল মৃতদেহ এবং মারাত্মক আহত অবাঙালি (বিহারি)। ট্রাক থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছিল। ঈশ্বরদীর বিভিন্ন এলাকার বিহারিরা মসজিদটি ঘিরে রেখেছিল। ওদের উদ্দেশ্য, মসজিদের ভিতর অবস্থানকারী বাঙালিদের হত্যা করা। ট্রাকের ভেতর মৃত ও আহত বিহারীদর দেখে ওরা উন্মাদ হয়ে ওঠে। মসজিদে অবস্থানকারী বাঙালিরা বুঝতে পারে, তাদের জীবন বিপন্ন। বিহারিরা ঢুকে পড়ে মসজিদের ভেতর। যারা যুবক, তাদের দিকে দেশীয় অস্ত্র ও ফায়ার আর্মস তাক করা হয়। ঠিক সেই সময় দেবদূতরূপী তিনজনের আর্বিভাব ঘটে। এই তিন জনই বিহারি। আব্দুল মজিদ খান। যিনি ঈশ্বরদীতে মজিদ কনট্রাকটর নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন আমার বাবার বন্ধু। আমাদের পরিবারের সঙ্গে তাদের সখ্য ছিল। আমি মজিদ খানকে চাচা বলে ডাকতাম। তার পরিবারের প্রায় সবাই এখন নিউজিল্যান্ডে বসবাসরত। মজিদ চাচা সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
আজম ভাম। যিনি ঈশ্বরদীতে আজম নামে পরিচিত। আজম ভাই ছিলেন ফুটবলার। থাকতেন লোকো সেডে। স্বল্পভাষী, ফর্সা, লম্বা ও সুদর্শন আজম ভাইয়ের সঙ্গে ছিল আমার চমৎকার সম্পর্ক। কারণ, আমিও ফুটবলার ছিলাম। আজম ভাইয়ের সঙ্গে আছে আমার অনেক স্মৃতি। আজম ভাইয়ের পরিবার ছিল তৎকালীন বোম্বাই শহরের আধিবাসী। তাদের পারিবারিক পদবী ভাম। আজম ভাই বর্তমানে অসুস্থ। ঢাকাতে বসবাসরত তৃতীয়জনের নাম আমি সংগ্রহ করতে পারিনি। তবে তিনি সেই সময়ে পাকশীতে বসবাস করতেন। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। এই তিনজনের হাতে ছিল ৩৮ বোরের রিভলবার। যা সেনাবাহিনী ব্যবহার করে। এই তিনজন মসজিদে অবস্থানকারী বাঙালিদের হত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। শুরু হয় হত্যায় চেষ্টাকারীদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক। ফায়ার আর্মসের ট্রিগারে হাতের আঙুল চলে যায় উভয় পক্ষের। প্রাণ রক্ষাকারী তিনজনের দাবি। মসজিদের আশ্রয়লাভকারী কোন বাঙালিকে হত্যা করা যাবে না। মসজিদ পবিত্র স্থান। এর ভেতর হত্যা ইসলাম ধর্ম অনুমোদন দেয় না। তখন উভয় পক্ষ একটি সমঝোতায় উপনীত হয়। মসজিদের ভেতরে নয়। বাইরে এলে বাঙালিদের হত্যা করা হবে। মসজিদের দরজায় এক বিহারি সেনট্রি হিসাবে থাকেন। তখন উভয় পক্ষ মসজিদ প্রাঙ্গণ ত্যাগ করে। পার হয় দিন। নামে সন্ধ্যা। বাঙালিদের ভেতর মৃত্যু ভয়। মসজিদের ভেতর আলোচনাসাপেক্ষে ১৭ জনের একটি দল হয়। এই দলে একজন নারী ছিলেন। আর ছিলেন আমার পরিচিত বড় ভাই খালেকুজ্জামান মাসুম। রাত গভীর। এই ১৭ জন মসজিদ থেকে বেরুনোর উদ্যোগ নিল। বাধা দিল অবাঙালি সেনট্রি। ১৭ জন বাধা উপেক্ষা করে বেরিয়ে যায় মসজিদ থেকে। এই সংবাদ চলে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে। ওরা পিছু নেয় বাঙালিদের। কিন্তু ১৭ জনের দল পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে সমর্থ হয়।
পরদিন সকাল বেলা। শুরু হয় বাঙালি নিধন। অবাঙালিরা ঘিরে ফেলে মসজিদ। ছোট ছোট দলে বিভক্ত করা হয় বাঙালিদের। নিয়ে যাওয়া রেল লাইন সংলগ্ন একটি গর্তের কিনারায়। এই বধ্যভূমিটি সাপ্তাহিক ঈশ্বরদী ও প্রেসক্লাবের অনতি দূরে। বাঙালিদের জবাই করে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দেয় হাসনাত কসাই ও নাকাতুল্লাহ কসাই। এই কসাই দুজন বহু মানুষকে নিজ হাতে হত্যা করে। এদেরকে সহায়তা করে রাজাকার ও তাদের নেতারা।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম স্বাধীনতা যোদ্ধাদের যে দলটি ঈশ্বরদীতে প্রবেশ করে, সেই দলে আমিও ছিলাম। এই দলটি যাত্রা শুরু করে ঈশ্বরদী অভিমুখে ১৮ ডিসেম্বর। যাত্রা শুরু হয় মানিকনগর কাঠেপাড়া ক্যাম্প থেকে। পায়ে হেঁটে দুই লাইনে বিভক্ত হয়ে আমরা আসছিলাম। তখন ঈশ্বরদীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ছিল সাঁড়া মাড়োয়ারি হাইস্কুলের শহীদ মিনার। আমাদের লক্ষ্য, শহীদ মিনারে দেশ গড়ার শপথ নেব। তারপর যে যার গন্তবে চলে যাবো।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে আব্দুল মজিদ খান, তার বড় ছেলে নাসিম খান এবং আজম ভাই বাঙালি নিধনে সক্রিয় ছিলেন। এই ভুল তথ্য ছিল স্বাধীনতা যোদ্ধাদের কাছে। কাজেই এই তিনজনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যোদ্ধাদের প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল। দলটি যখন ব্লাকপাড়া (বর্তমানে কাচারীপাড়া) মোড়ে পৌঁছায়, তখন আব্দুল মজিদ খান ব্লাকপাড়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন। স্বাধীনতা যোদ্ধাদের যারা এই দলে ছিলেন, তাদের কয়েক জন: প্রয়াত মতিউর রহমান কচি ও প্রয়াত গোলাম মোস্তফা বাচ্চু (দুই ভাই), আব্দুস সামাদ মজনু ও আব্দুল আজীজ সিদ্দীক আমার এই দুই ভাইও আজ প্রয়াত), প্রয়াত হাবিবুর রহমান হবি, মন্টু ভাই, প্রয়াত আব্দুল খালেক রবি (সাবেক কমিশনার) প্রমুখ। মজিদ খানকে দেখা মাত্র স্বাধীনতা যোদ্ধাদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়। আব্দুল খালেক রবি ভাই, আব্দুল মজিদ খানকে গালাগালি শুরু করেন। রবি ভাইয়ের হাতে ছিল এস এমজি। ম্যাগাজিনে বুলেট ছিল ৩২ রাউন্ড। আমি দেখছি, এসএসজি উদ্যেত হলো মজিদ খানের বুক বরাবর। রবি ভাইয়ের তর্জনি ট্রিগারে। চাপ দেওয়ার মুহূর্তে দেখা গেল একটি ইন্ডিয়ান আর্মির জিপ এগিয়ে আসছে। ইন্ডিয়ান আর্মি মজিদ খানকে উঠিয়ে নিল জিপে। প্রাণ রক্ষা হলো মজিদ চাচার। তারপর আমরা গেলাম মাড়োয়ারী স্কুলের শহীদ মিনারে। এগুলো সবই ১৯৭১ সালের কাহিনী। যত দিন বাংলাদেশ আছে, তত দিন ১৯৭১ সাল থাকবে। যতদিন বাংলা দেশ আছে, ততদিন ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম থাকবে। একটি দেশের স্বাধীনতারই ইতিহাস বিকৃত করা, সেই দেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতি। আসুন, আমরা এই ক্ষতির হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করি।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশ্বব্যাপী "হেল কমান্ডো" বইয়ের লেখক