চলতি বছরের শুরু থেকেই এবার এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ ছিল চোখে পড়ার মতো। ক্রমেই এটি আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। আক্রান্তের সাথে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। শুধু মাত্র সবশেষ ২৪ ঘন্টায়ই (শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে শনিবার সকাল ৮ টা পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে প্রাণহানি হয়েছে ১০ জনের। একই সময়ে দেশের সরকারি-বেরসাকরি বিভিন্ন হাসপাতালে ৯৬৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এতে করে চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১০ জন এবং আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৬৩ হাজার ১৬৫ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, হাসপাতালে নতুন ভর্তিদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বইরে) ১২৫ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বইরে) ৭১ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে) ১৬৯ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ২৭২ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ১৮০ জন, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বইরে) ৮১ জন রয়েছেন। এছাড়া ময়মনসিংহ বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বইরে) ৪০ জন, রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বইরে) ২১ জন, রংপুরে (সিটি করপোরেশনের বইরে) ২ জন এবং সিলেট বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বইরে) ৫ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
সবশেষ ২৪ ঘন্টায় মৃত ১০ জনের বরিশালে (সিটি করপোরেশনের বইরে) ৩ জন, ঢাকায় (সিটি করপোরেশনের বইরে) ১ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৪ জন, খুলনায় (সিটি করপোরেশনের বইরে) ১ জন এবং ময়মনসিংহে (সিটি করপোরেশনের বইরে) ১ জন রয়েছেন।
এদিকে গত এক দিনে সারা দেশে ৭৯১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ছাড়পত্র পেয়েছেন ৫৮ হাজার ৭২৯ জন।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, জানুয়ারির শুরু থেকে এ পর্যন্ত দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে শুধুমাত্র সরকারি হিসেবেই ৬৩ হাজার ১৬৫ জন রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৫৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৯ জন, মার্চে ৩১১ জন, এপ্রিলে ৫০৪ জন, মে মাসে ৬৪৪ জন, জুনে ৭৯৮ জন, জুলাই মাসে ২ হাজার ৬৬৯ জন, আগষ্টে ৬ হাজার ৫২১ জন, সেপ্টেম্বরে ১৮ হাজার ৯৭ জন, অক্টোবর মাসে ৩০ হাজার ৮৭৯ জন। অর্থাৎ চলতি বছরের শুরু থেকে ৯ মাসে যতো লোক আক্রান্ত হয়েছে শুধুমাত্র অক্টোবরে তার দ্বিগুণ বেশি আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া চলতি নভেম্বর মাসের গত দুই দিন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ৩৪৮ জন।
সূত্র আরো জানায়, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ইতিমধ্যে ৩১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে জানুয়ারি মাসে মৃতের সংখ্যা ছিল ১৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন, মার্চে ৫ জন, এপ্রিলে ২ জন, মে মাসে ১২ জন, জুনে ৮ জন, জুলাইতে ১২ জন, আগস্টে ২৭ জন, সেপ্টেম্বরে ৮০ জন, অক্টোবরে ১৩৪ জন। মৃতের দিক দিয়েও চলতি বছরের শুরু থেকে গত ৯ মাসের প্রায় দেড়গুন বেশি আক্রান্ত হয়েছে অক্টোবর মাসে। এছাড়া চলতি নভেম্বরের ২ দিনে মোট ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ড. আতিকুর রহমান জানান, ডেঙ্গু এখন সিজনাল নেই, সারা বছরই হচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হলে এটা বাড়ছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিরোধক ওষুধ ব্যবহারের পাশাপাশি সিটি করপোরেশনে পক্ষ থেকে সব জায়গায় প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। একইসঙ্গে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর চৌধুরী বলেছেন, মশানিধনে শুধু জেল-জরিমানা আর জনসচেনতনা বাড়িয়ে কাজ হবে না। সঠিকভাবে জরিপ চালিয়ে দক্ষ জনবল দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
উল্লেখ্য, দেশের ইতিহাসে ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের।
ডেঙ্গুজ্বর একটি এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সাধারণত ডেঙ্গুজ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। উপসর্গগুলোর মাঝে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশিতে ও গাঁটে ব্যথা এবং গাত্রচর্মে ফুসকুড়ি। দুই থেকে সাত দিনের মাঝে সাধারণত ডেঙ্গু রোগী আরোগ্য লাভ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক রক্তক্ষরী রূপ নিতে পারে যাকে ডেঙ্গু রক্তক্ষরী জ্বর বলা হয়। এর ফলে রক্তপাত হয়, রক্ত অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং রক্ত প্লাজমার নিঃসরণ ঘটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কখনোবা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখা দেয়। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়।
কয়েক প্রজাতির এডিস মশকী (স্ত্রী মশা) ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। যেগুলোর মধ্যে এডিস ইজিপ্টি মশকী প্রধানতম। ভাইরাসটির পাঁচটি সেরোটাইপ পাওয়া যায়। ভাইরাসটির একটি সেরোটাইপ সংক্রমণ করলে সেই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে রোগী আজীবন প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে, কিন্তু ভিন্ন সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সাময়িক প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে। পরবর্তীতে ভিন্ন সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমিত হলে রোগীর মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। কয়েক ধরনের টেস্টের মাধ্যমে এবং ভাইরাসটি বা এর আরএনএ প্রতিরোধী এন্টিবডির উপস্থিতি দেখেও ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয় করা যায়। কয়েকটি দেশে ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধী টিকা অনুমোদিত হয়েছে। তবে এই টিকা শুধু একবার সংক্রমিত হয়েছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে কার্যকর। মূলত এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। তাই মশার আবাসস্থল ধ্বংস করে মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করতে হবে। এ জন্য এডিস মশার বংশবিস্তারের উপযোগী বিভিন্ন আধারে, যেমন- কাপ, টব, টায়ার, ডাবের খোলস, গর্ত, ছাদ ইত্যাদিতে আটকে থাকা পানি অপসারণ করতে হবে। শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরিধান করতে হবে।